আমদানিকারক থেকে ভোক্তা-পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ by রাজীব আহমেদ

সব ধরনের শুল্ক ও কর দেওয়ার পর এক কেজি জিরার গড় আমদানি মূল্য দাঁড়ায় ১৯৬ টাকা ৩০ পয়সা। পুরোপুরি আমদানিনির্ভর এ পণ্যটির বাজারে খুচরা দর ৪০০ থেকে ৪৬০ টাকা কেজি। এটা বড় বাজারের বড় ক্রেতাদের দাম। আর ছোট ক্রেতা যারা ৫০ গ্রাম বা ১০০ গ্রাম পরিমাণ জিরা কেনে তাদের জন্য প্রতি কেজি ৬০০ টাকারও বেশি।


জিরাসহ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি মূল্য ও বাজার দর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আমদানিকারক থেকে ক্রেতার হাতে পেঁৗছাতে পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
গত মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকে ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শুকনা মরিচ, হলুদ ও খেজুরের ক্ষেত্রে আমদানি ও পাইকারি পর্যায়ে এক শতাংশ করে এবং খুচরা পর্যায়ে ১০ শতাংশ মুনাফা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার থেকেই এ নিয়ম কার্যকর হয়েছে। সরকারের এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি মনিটরিং টিমসহ বিএসটিআইয়ের বাজার মনিটরিং টিম মাঠে থাকবে।
মুনাফা নির্ধারণ করা হয় সব খরচ বাদ দিয়ে। আর পণ্যের বিক্রিত দামের সঙ্গে কেনা দামের পার্থক্য হলো মোট লাভ। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসংগঠিত বাজার ব্যবস্থায় পণ্যের অতিরিক্ত দাম নিয়ন্ত্রণ কঠিন। পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ কত হবে, তা নির্ধারণ
না করে দেওয়ায় বেশি খরচ দেখিয়ে মুনাফা বেশি করার সুযোগ থেকেই যাবে।
পরিবেশক প্রথার অধীনে গঠিত দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল সম্প্রতি একটি হিসাব তৈরি করেছে। সেখানে মসুর ডাল, ছোলা, জিরা, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের আমদানি মূল্যের সঙ্গে সব ধরনের কর ও শুল্ক যোগ করে আমদানি খরচ বের করা হয়েছে। সেখানে ১ থেকে ২১ জুন পর্যন্ত আমদানি হওয়া পণ্যের গড় মূল্য হিসাব করা হয়। ওই গড় মূল্যের সঙ্গে ওই সব পণ্যের বাজারদরের গড় তুলনা করে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার এই চিত্র পাওয়া যায়।
বাজারে ইন্দোনেশিয়ার এক ধরনের লাল শুকনা মরিচ বিক্রি হচ্ছে। যার প্রতি কেজির দাম ১৬০ থেকে ১৯০ টাকা পর্যন্ত। কেউ এক কেজি বা তার বেশি ক্রয় করলে দাম কিছুটা কম। এর কম নিলে দাম অনেক বেশি। গড় দাম ১৭৫ টাকা ধরলে আমদানি মূল্যের পরে কেজিপ্রতি লাভ হয় ৭৩ শতাংশ। অথচ শুল্কসহ পণ্যটির আমদানি মূল্য প্রতি কেজি ১০১ টাকা। শুল্কসহ হলুদের আমদানি মূল্য দাঁড়ায় প্রতি কেজি ৬৩ টাকা ৮১ পয়সা। বাজারে আমদানিকরা হলুদের গড় দাম ১৩০ টাকা। মোট লাভ ১০৪ শতাংশ।
শুল্কসহ মসুর ডালের গড় আমদানি মূল্য প্রতি কেজি ৫৬ টাকা ৬৩ পয়সা। ঢাকার বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছোট দানার নেপালি ডাল এখন নেই। ঢাকার কাজীপাড়া বাজারে দেখা যায়, তুরস্কের বড় দানার মসুর ডালের কেজি ৮৫ টাকা। অন্যদিকে ছোট দানার আমদানিকরা মসুর ডালের দাম বিক্রেতারা হাঁকছেন ১২৫ টাকা। দাম ৮৫ টাকা ধরেই দেখা যায়, আমদানিকারক থেকে খুচরা দোকানে যেতে মসুর ডালের দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে।
এভাবে শুল্কসহ ছোলার গড় আমদানি মূল্য প্রতি কেজি ৬১ টাকা ৩৫ পয়সা। ঢাকার রহমতগঞ্জের পাইকারি দোকানে ছোলার গড় দাম ৬৭ টাকা। আর ঢাকার কারওয়ান বাজারে একই ছোলার কেজি ৮৫ টাকা। আরো ছোট বাজারে ৯০-৯৫ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হচ্ছে ছোলা।
দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয় মূলত ভারত থেকে। দেশটির পাটনা ও নাসিক জাতের পেঁয়াজের শুল্কসহ গড় আমদানি মূল্য প্রতি কেজি ১১ টাকা ৫৫ পয়সা। ঢাকার শ্যামবাজারে একই পেঁয়াজের পাইকারি দাম সাড়ে ১৪ থেকে ১৬ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু ঢাকার বড় খুচরা বাজারে এই পেঁয়াজ ২৪-২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। আর মহল্লার খুচরা দোকানে দাম আরো কিছুটা বেশি। হিসাব করে দেখা যায়, আমদানি মূল্যের চেয়ে ১০৮ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ।
রসুনের শুল্কসহ আমদানি মূল্য ৫৪ টাকা ৬২ পয়সা। বাজারে প্রতি কেজির দাম ৮০ টাকা। মহল্লার দোকানে আরো বেশি। পণ্যটি আমদানি মূল্যের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আদার শুল্কসহ গড় আমদানি মূল্য ৩৩ টাকা ৩৭ পয়সা। বাজারে দাম ৬০-৭০ টাকা। খুচরা বাজারে আমদানি মূল্যের চেয়ে ৯৪.৭৮ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে আদা।
এ কয়টি পণ্যের মধ্যে মসুর ডাল, ছোলা ও রসুনে মোট লাভ তুলনামূলক কম। এর কারণ এ পণ্যগুলো দ্রুত পচনশীল নয় বলে ঘাটতি কম হয়।
আমদানিকারকরা চট্টগ্রাম বন্দর অথবা বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সাধারণত পণ্য নিয়ে ঢাকার পাইকারি বাজারে অথবা আড়তে আসেন। বুড়িগঙ্গা ঘেঁষা শ্যামবাজারে মসলাজাতীয় পণ্য ও রহমতগঞ্জে ডাল বিক্রি হয়। সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা কিনে এনে দোকানে বিক্রি করেন। তবে ঢাকার বেশ কিছু স্থানে আরো কিছু পাইকারি বাজার আছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মঙ্গলবারের সভায় উপস্থিত ছিলেন মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, সব খরচ বাদ দিয়ে আমদানি ও পাইকারি পর্যায়ে ১ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ১০ শতাংশ মুনাফা করতে ব্যবসায়ীরা রাজি আছেন। গত বৃহস্পতিবার নিউ মার্কেটের বনতলা কাঁচাবাজার ও উত্তর ডি ব্লক মার্কেটের খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা হয়েছে। তাঁরা সানন্দে এটি মেনে নিয়েছেন। দোকানে পণ্যের দামের তালিকা টানাতেও তাঁরা রাজি আছেন।
হেলাল উদ্দিন বলেন, 'আমরা এটা করেছি সকাল-বিকেল দাম বৃদ্ধি রুখতে। প্রত্যেক পর্যায়ে কেনার রশিদ থাকায় কে কত দামে কিনছেন, কত দামে বিক্রি করছেন_তা তদারকি করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে আমদানিকারক, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফা করলে ধরা যাবে।'
এখানে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, এক কেজি জিরার আমদানি মূল্য সব খরচসহ যেখানে ১৯৬ টাকা, সেখানে পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ১১৯ শতাংশ বেশি দামে। তাহলে ১০৭ শতাংশই কি ব্যবসায়ীদের খরচ? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় তিন পর্যায়ে কত শতাংশ খরচ ধরা যাবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি।
খরচ বেশি হওয়ার জন্য পরিবহনসহ অন্য সব কিছুর দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করেন হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আগে বিদ্যুৎ বিল যা আসত, এখন তার দ্বিগুণ আসছে। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ, দোকানভাড়া, বাড়িভাড়া অনেক বেড়েছে। সে তুলনায় পণ্যের দাম ওই হারে বাড়ানো হয়নি।
যেখানে এক কেজি আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ১৫-১৬ টাকা। সেই পেঁয়াজ ঢাকার খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা দরে। শ্যামবাজার থেকে মিরপুর একটি ছোট ট্রাকের ভাড়া কম-বেশি এক হাজার টাকা। ওই ট্রাকে তিন টনেরও বেশি পণ্য পরিবহন করা যায়। এতে প্রতি কেজিতে পরিবহন খরচ ৩৩ পয়সা পড়ে। এর সঙ্গে ৩০ পয়সা আড়তদারের কমিশন। মোট দাম ১৬ টাকা ৬৩ পয়সা। ৫০ কেজিতে চার কেজি ঘাটতি হয় বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। ঘাটতি ১০ শতাংশ, দোকানভাড়াসহ অন্যান্য খরচ ১৫ শতাংশ ও ১০ শতাংশ মুনাফা ধরলেও মোট দাম ৩৫ শতাংশের বেশি বাড়ার কথা নয়। কিন্তু হিসাব করলে দেখা যায়, পরিবহন ও কমিশন বাদ দেওয়ার পরও শ্যামবাজার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত ৫০ শতাংশের বেশি দাম বেড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত মুনাফা করা হচ্ছে ১৫ শতাংশ।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মসলা বিক্রেতা মো. হাবিব কালের কণ্ঠকে বলেন, খুচরা ব্যবসায়ীরা এত হিসাব করে পণ্য বিক্রি করেন না। বাজার থেকে তাঁরা কম দামে পণ্য কেনার চেষ্টা করেন। আবার যার কাছ থেকে যত পারা যায় দাম নেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.