সন্ধান মেলেনি কোম্পানীগঞ্জের তিন শিশুর-বন্যা-পরিস্থিতির অবনতি, পানিবন্দী লাখো মানুষ

উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উত্তরবঙ্গের বন্যা-পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও সিলেটের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এসব জেলার লাখ লাখ মানুষ।


যমুনা, সুরমা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে বিভিন্ন শহর রক্ষা বাঁধ। বন্যাকবলিত বেশির ভাগ এলাকার সড়ক যোগাযোগ-ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পানিতে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। পানি উঠে যাওয়ায় শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
বগুড়া: যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সারিয়াকান্দির নয়টি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরদার জানান, যমুনার পানি বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ধুনটে গত ৪৮ ঘণ্টায় ভান্ডারবাড়ী পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে ভান্ডারবাড়ী-মাধবডাঙ্গা বিকল্প বাঁধসহ সহড়াবাড়ী ও বানিয়াজান স্পার। পাউবো জানায়, স্পার ও বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে মেরামতের প্রস্তুতি চলছে।
সিরাজগঞ্জ: যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের হার্ড পয়েন্টের দুটি সেকশনে বাঁধের নিচে নদীর তলদেশের দিকে গভীরতার সৃষ্টি হয়েছে। পাউবো জানায়, যমুনার পানি বাড়ায় সদর উপজেলার পৌর শহরের চরমালসাপাড়া, রানীগ্রাম ও পুঠিয়াবাড়ী মহল্লা, খোকসাবাড়ী ইউনিয়নের গুনারগাতী, শৈলবাড়ী, খোকসাবাড়ী ও কাওয়াকোলা, মেছরা ইউনিয়নের সাতটি গ্রাম, শাহজাদপুর উপজেলার সোনাতনী ও কায়েমপুর ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রাম, চৌহালী উপজেলার বাগুটিয়া, ওমরপুর ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম এবং কাজীপুর উপজেলার শুভগাছা, মাইজবাড়ী ও নাটুয়াপাড়া ইউনিয়নের আটটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে এসব এলাকার শত শত বিঘা জমির তিল ও পাট।
কুড়িগ্রাম: জেলার নয়টি উপজেলার ৫৩টি ইউনিয়নের ৬২ হাজার পরিবার বন্যাকবলিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় এগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। পাউবো জানায়, গতকাল বৃষ্টি না হলেও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমরসহ সব কটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় রৌমারী-ঢাকা সংযোগ সড়কের ঘোলাবাড়ী নামক স্থানে পানির স্রোতে ৪০ ফুট রাস্তা ভেঙে যায়। এর ফলে ধনারচর, কাশিয়াবাড়ী ও ঘোলাবাড়ী এলাকার শত শত ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়ে পড়েছে। রাস্তাটি ভেঙে যাওয়ায় রৌমারীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান জানান, কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী, ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, রৌমারী, রাজীবপুর, রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার ৫৩টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
এদিকে উলিপুরে বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও জ্বালানিসংকট দেখা দিয়েছে।
গাইবান্ধা: গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়ি উপজেলার ৩৩টি গ্রাম গতকাল প্লাবিত হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে ফুলছড়ির রতনপুরে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। ঘাঘট নদের পানির চাপে গতকাল সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের নারায়ণপুরে সাতদামুয়া কাতলারবিল বাঁধের প্রায় ৫০ ফুট এলাকা ভেঙে গেছে। এতে বল্লমছাড়ের নারায়ণপুর, খোলাহাটি ইউনিয়নের কাজীবাড়ী, ফারাজিপাড়া, মিয়াপাড়া, বাহিরবন্দ, খোলাহাটি ও পশ্চিম কোমরনই এবং কুপতলা ইউনিয়নের বালুয়া ও দক্ষিণ চাপাদহ গ্রাম প্লাবিত হয়। গতকাল সন্ধ্যায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটের পানি ৫১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
সিলেট: ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি গতকাল বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। উপজেলার ভেলকোনা, সুড়িকান্দি, শাইলকান্দি, বাঘমারা, গয়াসি, সোনাপুর, পিঠাইটিকরের গুচ্ছগ্রাম, ভরাউট, ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের নাথ কলোনি, ইন্তাজ আলী মার্কেটের আবাসিক এলাকার ২৩ সহস্রাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে ফেঞ্চুগঞ্জের মধ্যবাজার ও হাসপাতাল-মাইজগাঁও সড়কটি। উপজেলার ১৫০ হেক্টর জমিতে রোপিত ফসল বন্যায় তলিয়ে গেছে বলে উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়।
গতকাল সুরমার নদীর পানি কানাইঘাটে বিপৎসীমার ১৪৭ সেন্টিমিটার ও সিলেটে ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা কৃষি ও মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, বন্যায় উপজলার আড়াই হেক্টর রোপা আউশ, ১০ হেক্টর বীজতলা, ১০০ হেক্টর শাকসবজি ও ৯০০ হেক্টর আমন ধান নষ্ট হয়ে গেছে। পুকুর ও মৎস্য খামার থেকে বেরিয়ে গেছে প্রায় কোটি টাকার মাছ।
অন্যদিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় পাহাড়ি ঢলে যে তিনটি শিশু ভেসে গেছে, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত তাদের সন্ধান মেলেনি। এ ঘটনায় তাদের অভিভাবক বৃহস্পতিবার রাতে কোম্পানীগঞ্জ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে। পুলিশ শিশু তিনটির সন্ধান-তৎপরতা শুরু করেছে। এরা হলো: সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার পাথরশ্রমিক আবদুল খালিকের মেয়ে শবনম (৫), মাছিমপুরের সুলতান মিয়ার মেয়ে মারজিয়া (৫) ও শাল্লার মারকুলির নাসির মিয়ার মেয়ে মুক্তা বেগম (৩)।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সিলেট, বগুড়া, কুড়িগ্রাম ও সিরাজগঞ্জের নিজস্ব প্রতিবেদক এবং গাইবান্ধা, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, উলিপুর, সারিয়াকান্দি ও ধুনট প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.