সদরে অন্দরে-যদি কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হয় by মোস্তফা হোসেইন

ছিমছাম ঘর। সোফা-কার্পেটসহ আধুনিক সুবিধার সবই আছে। এক কোনায় ডেস্কে বসে কাজ করছেন একজন হিসাবরক্ষক। এ অভ্যর্থনাকক্ষটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সামনের কক্ষে বসা অভিভাবকরা। সবাই ধীরস্থির। বোঝা যায়, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার মানসিকতা নিয়েই তাঁরা এখানে আছেন।


ভেতরে প্রবেশকারী তরুণ-তরুণীদের চেহারায় স্পষ্টত ব্যস্ততার ছাপ। অভ্যর্থনাকক্ষ পেরিয়ে ওরা ঢুকছে ভেতরে। সবার হাতে ব্যাগ। বই-খাতায় ভরা।
চিত্রটি ঢাকার শাজাহানপুর এলাকার একজন শিক্ষকের ঘরের। কোচিং সেন্টার কি সেটি? সফল সেই শিক্ষক। তিনি পড়ান ঢাকা কলেজে। বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক। খারাপ ছাত্রদের পড়ার সুযোগ হয় না সেখানে। তাই সেখানে যারা পড়ে, তাদের ফল বিপর্যয় হওয়ার আশঙ্কা নেই। নটর ডেম, ভিকারুননিসা কিংবা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাই বেশি সেখানে। এটা কি কোচিং সেন্টার, নাকি কোনো প্রাইভেট কলেজ? শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেখে তেমন প্রশ্ন আসতেই পারে। তারা ৪৫০ জন। বিভিন্ন ব্যাচে জনপ্রতি হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের পড়তে হয়। বছর শেষে সেরা ফল লাভকারী শিক্ষার্থীকে আকর্ষণীয় পুরস্কারও দেন ওই শিক্ষক।
এইচএসসি পরীক্ষার আগে তিনি বিশেষ মডেল টেস্টের আয়োজন করেন। ওই টেস্টে যে কেউ অংশ নিতে পারে। প্রত্যেক শিক্ষার্থী এর জন্য কমপক্ষে তিন হাজার টাকা করে দিতে বাধ্য থাকে। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কখনো ৬০০-ও ছাড়িয়ে যায়। এই হিসাবে শুধু মডেল টেস্টের মাধ্যমেই তিনি আয় করেন ১৮ লাখ টাকা।
শাজাহানপুরের এই শিক্ষকের লাখ লাখ টাকা রোজগার দেখে কারো ঈর্ষা করার কথা নয়। যেকোনো ব্যক্তিরই অধিকার আছে নিজের মেধা কিংবা আর্থিক পুঁজি খাটিয়ে অর্থ উপার্জন করার। কিন্তু তিনি যাদের এ ব্যবসায় ব্যবহার করছেন, তারা ঢাকার কোনো না কোনো শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থী। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত সেরা কয়েকটি স্কুলের মধ্যে অন্যতম। প্রশ্ন হলো, তাহলে ওইসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কী পড়ানো হয়?
স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের কারিকুলাম সম্পন্ন করার কোনো সুযোগ নেই। এর পেছনের কারণগুলোও স্পষ্ট। শিক্ষকদের অবহেলার কারণে এমনটি হচ্ছে_সর্বক্ষেত্রে এটাও বলা যায় না। ব্যতিক্রম বাদ দিলে শিক্ষকরা পাঠদান করতে গিয়ে ফাঁকি দেন কম। তার পরও স্কুলে কোনো শিক্ষার্থীরই কারিকুলাম সম্পূর্ণ শেষ করে দেওয়া সম্ভব হয় না। সেখানেও যৌক্তিক কারণ আছে। স্কুলগুলোর ছুটির হিসাবের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, কেন সম্ভব হয় না। একটি স্কুলে এসএসসি ও জেএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থাকে। তাহলে সেই স্কুলের ক্লাস বন্ধ থাকে কমপক্ষে দুই মাস। তারপর আরো ৮৪ দিন উৎসব ছুটি আছে। সাপ্তাহিক ছুটি ৫২ দিন (যার মধ্যে অবশ্য উৎসব ছুটির কিছুদিনও পড়ে যায়)। তারপর আছে শিক্ষার্থীদের অসুখবিসুখ, শিক্ষকদের নৈমিত্তিক ছুটি এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মতো আরো কিছু বিষয়।
আবার শ্রেণীসময় ও পরিবেশের বিষয়টিও এসে যায়। টিফিন পিরিয়ডের আগে একেকটি বিষয়ের জন্য শিক্ষার্থীরা সময় পায় ৪০ মিনিট। টিফিনের পরের প্রতিটি বিষয়ের জন্য পাঠদানের সময় কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩০ মিনিটে। প্রতিটি ক্লাসে যোগদানের জন্য শিক্ষককে অবশ্যই কম করে হলেও পাঁচ মিনিট সময় নিতে হয়। ফলে প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি বিষয়ের জন্য পাঠদানের সময় থাকে মাত্র ৩৫ ও ২৫ মিনিট। এবার আসা যাক পরিবেশ বিষয়ে। প্রায় সব স্কুলেই প্রতিটি ক্লাসে ৮০ জন বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী থাকে। একজন শিক্ষকের পক্ষে ২৫ মিনিটে এই ৮০ জন শিক্ষার্থীকে কি একটি বিষয় ভালোভাবে পড়ানো সম্ভব? এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষায়তন থেকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষালাভ অসম্পূর্ণই থেকে যাচ্ছে। তাহলে শিক্ষার্থীকে সিলেবাস সম্পন্ন করার জন্য কী উপায় অবলম্বন করতে হবে। তখনই কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়ার ওপর শিক্ষার্থীরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
এ কারণেই অভিভাবকরা ছুটে যান কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়ানোর সুবিধা খোঁজার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়ানোর ব্যয় নির্বাহের মতো আর্থিক সংগতি কয়জন অভিভাবকের আছে। সাধারণ ধারণাও এখানে কাজ করে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষায়তনে যাবে শিক্ষালাভের জন্য। সেখানেই শিক্ষালাভ শেষ হওয়া উচিত। এর ব্যত্যয় হওয়াটাকেই বা কেন মেনে নেওয়া হবে। প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পেরেই অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ জমা হয়েছে। সাধারণ মানুষও এই ক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। তাই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। নীতিমালাও প্রণীত হয়েছে এ বিষয়ে। শিক্ষকদের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি এ সিদ্ধান্ত।
ঢাকার একটি সরকারি স্কুলের একজন শিক্ষক বললেন, 'আমরাও চাই না দিনের পরিশ্রম শেষে রাতে আবার কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিউশনির মতো খাটুনি খাটতে। আমরা এটা করছি নিতান্তই বেঁচে থাকার জন্য।' উদাহরণ দিয়েই বললেন, '১০ বছর শিক্ষকতা শেষ করার পর এখন বেতন পাই মাত্র ২৯ হাজার টাকা।' তাঁর বক্তব্যে যুক্তি আছে। কারণ ঢাকায় তিন কক্ষের একটি বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে মাস শেষে বাড়িওয়ালার হাতে ধরিয়ে দিতে হয় কমপক্ষে ১৮ হাজার টাকা। তাহলে বাকি থাকে মাত্র ১১ হাজার টাকা। এই টাকায় যাতায়াত খরচ থেকে শুরু করে আহার, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির মতো জরুরি ব্যয় নির্বাহ করা কি সম্ভব? কিন্তু বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের দুর্দশা চরমে। তাঁরা মূল বেতনের শতভাগ সরকারি তহবিল থেকে পেয়ে থাকেন। একজন সহকারী শিক্ষক সরকারি তহবিল থেকে মাসে সাত হাজার ৭০০ টাকা পেয়ে থাকেন, যা টাইম স্কেলের মাধ্যমে ১১ হাজার টাকা পর্যন্ত উন্নীত হয় এই টাকা। এর বাইরে একজন শিক্ষক স্কুল থেকে খুবই সামান্য টাকা পেয়ে থাকেন। আবার কোনো কোনো স্কুল আছে, যারা সরকারি অংশের বাইরে কোনো টাকাই দেয় না। প্রশ্ন আসে, তাহলে ওই শিক্ষক তাঁর দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করবেন কিভাবে? তবে আশার কথা, সরকার নতুন নীতিমালায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে ভিন্ন স্কুলের সর্বাধিক ১০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। আবার ক্লাস সময়ের আগে ও পরে স্কুলেও কোচিং করানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। সেই কোচিংয়ের ফিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ক্লাসভিত্তিক কোচিং করার এ সুযোগ তাই শিক্ষকদের আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে। গ্রাম ও শহরভেদে এই হার নির্ভরশীল হওয়ায় এটি আরো যৌক্তিক বলে মনে করি। তবে সবার আগে প্রয়োজন আর দশটা পেশার সঙ্গে মিল রেখে নিজেদের চাহিদা নিরূপণ এবং সেভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের প্রবণতা বন্ধ হওয়া জরুরি। তা করতে পারেন বিবেকবান শিক্ষকরা।

mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.