সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচন-দলীয় লেজুড়বৃত্তি by মিজানুর রহমান খান

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে এবার ভোটার সংখ্যা ১৯৭১। ২৪ ও ২৫ মার্চ নির্বাচন। স্বাধীনতা দিবসের প্রথম প্রহরে শোনা যাবে নির্বাচনী ফল। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটা ব্যাপার থাকাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এই চেতনার সংজ্ঞা যদি হয় বিচারিক স্বাধীনতা,


বিচারবিভাগের স্বায়ত্তশাসন বা আইনের শাসনের ঝাণ্ডা তুলে ধরা কিংবা নির্দিষ্টভাবে বিচারবিভাগীয় সংস্কারের সপক্ষে কোনো এজেন্ডাকে জনগণের সামনে আনা; তাহলে আক্ষেপ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এ নির্বাচনের মন-মেজাজে বাগাড়ম্বর ও মেঠো বক্তৃতার সুর উদগ্র। ভালো কিছু বা দরকারি বিষয় সত্যিই পুরোপুরি অনুপস্থিত। সুপ্রিম কোর্ট বার ঐতিহ্য ও কৌলীন্য হারাচ্ছে। এটি পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতাক্ষয়িষ্ণু এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার হুমকির মুখে রয়েছে।
স্বাচিপ ও ড্যাবের মতো দুই বড় দলের অঙ্গ হিসেবে শোভাবর্ধন করছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। প্রার্থীরা শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার আশীর্বাদধন্য। আইনজীবীদের জন্য এটা যে একটা লজ্জার বিষয় সেটাও অনেকে বিস্মৃত হচ্ছেন। বরং দলীয় নেতৃত্বের খাস তালিকায় নামভুক্তিকে একটা গর্বের ব্যাপার মনে করা হচ্ছে।
এটা এখন সন্দেহাতীত, সর্বোচ্চ বিচারালয়ের আইনজীবী সমিতি ক্রমশ মূল দলের লেজুড়ে পরিণত হচ্ছে। এই অঙ্গনের রাজনীতি আর সংসদ নির্বাচনের টিকিট জোগাড়ের রাজনীতি মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। মুলো দুটো। বিচারক কিংবা সাংসদ পদ। যখন যাকে যেটা দিয়ে তুষ্ট রাখা যায়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটা প্রহসনের নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনের বিজয়ী সাংসদও বিচারক হয়েছেন।
রাজনৈতিক দল ও নেত্রীর খেদমতগার হওয়ার ইঁদুর দৌড় এখন সহজেই চোখে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে রাখঢাক বা চক্ষুলজ্জা দ্রুত লোপ পাচ্ছে। মূলধারার অনেক নেতা-কর্মীর মতো বার নেতারাও সক্রিয়, উদ্বিগ্ন কিংবা উদ্ভ্রান্ত। বইপত্র পাঠের পরিবর্তে অনেকেই যেন সতত হাইকমান্ডের মনোভাব পাঠে সচেষ্ট থাকেন। রাজনীতিতে শেষ কথা নেই। এ কথা বলে রাজনীতিকেরা নীতিহীন কাণ্ডকারখানা জায়েজ করেন। সেই প্রবণতা এই অঙ্গনেও চলছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির বর্তমান প্যানেলের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন রীতিমতো একজন এমজে। এমজে মানে মহাগুরু। তাঁর ডিগবাজি অতুলনীয়। বাংলাদেশের ম্যাকিয়াভেলীয় রাজনীতিটা তিনি সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে গেছেন। তিনি কখনো স্বতন্ত্র, কখনো জাতীয় পার্টি বা বিএনপি। তাঁদের টিকিটে তিনটি সংসদ নির্বাচনে তিনি দাঁড়ান। পরাজিত হন। আওয়ামী লীগের খাতায়ও তাঁর নাম আছে। এই তিনিই প্রায় একই সময়ে সুপ্রিম কোর্টের বার সভাপতির নির্বাচনেও চারবার প্রার্থী হন। প্রত্যেকবারই পরাজিত হন। ফুলের তোড়া হাতে তিনি দুই বড় দলেই যোগ দেন। কাউকে বিয়োগ করেন না। দুই দলই কিন্তু তাঁকে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি পদে টিকিট দিয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হয়েও ২০০৭ সালে নির্বাচন করা হয়নি। কারণ, জরুরি অবস্থায় ভোটই হয়নি। পরের বছর প্রথমে আওয়ামী লীগের টিকিট পান। কিন্তু পরে নেত্রীর ইচ্ছায় বিকল্প প্রার্থী আসে। তাঁর নৌকা ডোবে। এবার তিনি পঞ্চমবারের মতো সভাপতির লড়াইয়ে রয়েছেন। ভালো আইনজীবী হিসেবে তাঁর একটা সুনাম অবশ্য সুবিদিত। কিন্তু ডিগবাজি বা সর্বদলীয় হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তি। ভয় হয় তিনিই কিনা এ অঙ্গনের আদর্শ বা নমস্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
আওয়ামী লীগের প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী মো. মুনসুরুল হক চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক। আওয়ামী লীগের বিগত সরকারে তিনি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হন। পরে তাঁকে বিচারক করা হয়। কিন্তু বিএনপি তাঁকে আওয়ামী লীগার বিবেচনায় স্থায়ী করেনি।
বারের ১৪টি পদের বিপরীতে ৩৬ জন লড়ছেন। পুনর্নির্বাচিত হতে চেয়েছিলেন বর্তমান সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম। কিন্তু বাদ সাধলেন মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। সমন্বয় পরিষদ ‘দলের বৃহত্তর স্বার্থে’ পুনঃ প্রার্থীবিরোধী এক নীতিগত অবস্থান নেয়। কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কৌতুক হলো, তাঁর নামকরণ। তিনি লর্ড ভানু বন্দ্যোপাধ্যয়। লর্ড কীভাবে হলেন? দেশভাগের আগে তিনি পূর্ব বাংলায় ল্যান্ডলর্ড ছিলেন। তো ল্যান্ড ফেলে এসেছেন। লর্ডটা কী করবেন? তাই বহন করছেন। সেভাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে নন্দিত একটি ব্যানার ছিল সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ। সেই পরিষদ মৃত। কিন্তু নন্দিত নামটা ব্যবহার করছেন আওয়ামী তরিকার আইনজীবীরা। এই পরিষদের ভেতরে এক হালি সংগঠন আছে।
প্রথমত, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। এটি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও এর সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেননি। ওই পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ঢাকার জজকোর্টের পিপি আবু আবদুল্লাহ। কয়েক দিন পর তাঁকে বিচারপতি হিসেবে পেলে অবাক হব না। দ্বিতীয়টির নাম গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি। এতে বিভক্তি এসেছে। এর সভাপতি আইনমন্ত্রী স্বয়ং। তিনিও ইস্তফা দেননি। তৃতীয়টি, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ। চতুর্থটি জাসদসমর্থিত জাতীয় আইনজীবী সমিতি। এ ছাড়া সরকারি দলের জন্য আইন কর্মকর্তাদের সেবা সর্বদা অটুট থাকে।
জাতীয় রাজনীতির মতো এখানেও তৃতীয় ধারার ঠাঁই নেই। এবার একটা প্যানেল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঐক্য টেকেনি। আওয়ামী ঘরানার অনেকে নির্দলীয় ও দলীয় দুটো পরিচয় একই সঙ্গে বহন করতে পছন্দ করেন। তাঁরা নিজেদের এই সমন্বয় পরিষদভুক্ত বলেন। আইনের লোক বলে কথা, তাই তাঁরা বিলক্ষণ আইন মানেন। বড় কোর্টে একটা দশদশার ব্যাপার আছে। বিচারক হতে বারে ১০ বছর থাকা লাগে। বারের নির্বাচনে প্রার্থী হতেও একই শর্ত। বিএনপি ১০ ছুঁতেই একজনকে বিচারক করেছিল। এবার প্রায় কাছাকাছি একটা কাণ্ড ঘটল। বারের নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ১০ মার্চ। ৭ মার্চে ওই দশদশা পূরণ করেন মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। ওই রাতেই তাঁর প্রার্থিতা চূড়ান্ত হয়। কে তিনি? তিনি ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের হয়ে গত সংসদ নির্বাচনে মস্ত বড় ভূমিকা রাখেন। এটা সেই সেবার পুরস্কার বলে অনেকেই মনে করেন।
সুপ্রিম কোর্ট বারে সমতালে বিএনপির পক্ষে লেজুড়বৃত্তি চলছে। গুলশানে বিএনপির চেয়ারপার্সনের কার্যালয় থেকে রাতবিরাতে ঘোষিত হলো বার প্রার্থীদের নাম। বার ও বেঞ্চকে বলা হয় এক ইগলের দুই ডানা। এবার বুঝুন অবস্থা! রাজনীতিক কাম আইনজীবীদের নেতৃত্বে রয়েছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। জামায়াতের রয়েছে ইসলামিক লইয়ার্স কাউন্সিল। তাদের ভান্ডার দলীয় সেবার নানাবিধ উপচারে ভরপুর। এসব দেখেশুনে বারের অভিজ্ঞ ও নবীন আইনজীবীদের নিশ্চয় রক্তক্ষরণ ঘটে। কিন্তু ভোট এলে তাঁরা নীরবে ভোট দেন। ভোটটা নষ্ট করেন না! তাঁদের চোখের সামনে ক্যাডারগিরি চলে। সুপ্রিম কোর্টের পবিত্রতা নষ্ট হয়। কিন্তু তাঁরা গ্রামের অসংগঠিত নিরীহ মানুষের মতো ঝামেলা এড়ান। সুখে থাকেন। তাঁরা জানেন, সুপ্রিম কোর্টে ট্রেড ইউনিয়নগিরি নিষিদ্ধের দাবি তুললে তাঁদের সম্মানহানি ঘটতে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.