অবক্ষয়-২০ ঘর মানুষ, একটি ধর্ষণ এবং অবিরত ‘ক্রসফায়ার’ by ফারুক ওয়াসিফ

কোনো কোনো ঘটনার মধ্যে আমাদের সার্বিক অবস্থার চালচিত্র ঝলক দিয়ে ওঠে; চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে আমরা কোথায় আছি! গত ২১ মার্চের প্রথম আলোর একটি শিরোনাম তেমন এক অন্যায়, তেমন এক চমকানো দুর্যোগের ইশারা হয়ে জ্বলজ্বল করছে।


শিরোনামটি হলো, ‘বড় বোনকে আটকে রেখে ছোট বোনকে ধর্ষণ, ২০ ঘর লোক নিশ্চুপ।’ ধর্ষণ এখন আমাদের দৈনন্দিন ঘটনাবলির অংশ। কিন্তু প্রকাশ্যে সবার চোখের সামনে? এই ঢাকাতেই?
১৫ বছরের কিশোরীটিকে পাকড়াও করার জন্য লাফঝাঁপ চলছিল সন্ধ্যা থেকেই। প্রথমবার যখন তারা আসে, মেয়েটি বঁটি হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু রাতের বেলা আর ঠেকাতে পারেনি। টিনের ছাপরার দরিদ্র বসতির মধ্যে ভাড়া করা এক ঘরের আবাসে থাকত বড় বোন। গার্মেন্টসে কাজ করে সংসার চালায়। গ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছিল আদরের ছোট বোনটি। সন্ত্রাসীর হাত থেকে বাঁচতে দুই বোন প্রথমে পাশের ঘরের বাসিন্দাদের কাছে আশ্রয় নেয়। প্রতিবেশীটির সঙ্গে বখাটেদের ফিসফিস ফোনালাপে আরও ভয় পেয়ে দৌড়ে যায় বাড়ির কেয়ারটেকারের ঘরে। সেখান থেকেই তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বোনের ঘরেই পালা করে তাকে ধর্ষণ করা হয়। বোনটি আটকা থাকে আরেক ঘরে। খবরে ছাপা হয়েছে, ‘অল্প কিছু সময় চিত্কারের পর মেয়েটির আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি।’ কেউ এগিয়ে আসেনি। যদি একজনও ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদ করত, তাহলে সেই একজনকে আঁকড়ে ধরে বলতে পারতাম, মনুষ্যত্ব এখনো মরেনি। কিন্তু মেয়েটির এবং আমাদের দুর্ভাগ্য, সেখানে সে রকম কেউ ছিল না। ওই মুহূর্তে এক ১৫ বছরের কিশোরীই শুধু ধর্ষিত হয়নি, ধর্ষিত হয়েছে আমাদের বিবেক, আমাদের ন্যায়বোধ। যদি একজনও সাহসী হয়ে এগিয়ে যেত, তাহলে আমরা তার সঙ্গেই একাত্ম হয়ে ভাবতে পারতাম, সবার হয়ে একজন তো দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কেউ না দাঁড়ানোয় আমরা সবাই-ই যেন দোষী হয়ে গেছি।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ২০টি ঘরের শখানেক মানুষের কারও সাহস হয়নি বাধা দেয়। ধর্ষিতার চিত্কার রাস্তা থেকেও শোনা যাওয়ার কথা। কিন্তু কেউ আসেনি। পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা একটি নিষ্ঠুর নির্যাতনলীলার মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে বসে থেকেছে। কারণ ধর্ষকেরা শক্তিশালী, তাদের প্রধানজন স্থানীয় কৃষক লীগের সভাপতির পুত্র। তারা নির্দল নয়, তাদের দল শক্তিশালী এবং ক্ষমতাসীন। তবে নারী নির্যাতনের জন্য দল লাগে না, ক্ষমতাবান পুরুষ বা ক্ষমতার আশ্রয়ধন্য হলেই হয়।
দেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটছে, যাতে ওই ২০ ঘর মানুষের মতোই চুপ করে আছি আমরা। র‌্যাবের অব্যাহত ক্রসফায়ার সে রকমই এক বিপর্যয়। গত ১৬ মার্চ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে আলাউদ্দিন নামের এক তরুণ বাসচালককে প্রকাশ্যে তাঁর মা-ভাই-বোনের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। র‌্যাবের অভিযোগ, ওই তরুণ মাদক ব্যবসায়ী। তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে বটে, তবে সেটা ঘটনার পরে। আলাউদ্দিনের মা এখন বিচার চান না, ছেলের লাশ ফেরত চান।
ক্রসফায়ারে নিহতদের মধ্যে অনেকেরই নাম এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিযোগ ছিল না। এসবের মধ্যে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ছিল কায়সার মাহমুদ বাপ্পী নামের এক কলেজছাত্র হত্যার ঘটনা। হত্যার পর তার লাশকে জনৈক কামরুল ইসলাম বাপ্পী নামক সন্ত্রাসীর লাশ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু না সরকার, না র‌্যাব-পুলিশ—কেউই ব্যাখ্যা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। যাদের ভুলের দাম নিরীহ মানুষের জীবন, তাদের এভাবে আইন, সংবিধান, জবাবদিহি ও বিচারের ঊর্ধ্বে রেখে কি নিরাপদ নিদ্রা সম্ভব? অপরাধী হলেই কি বিনা বিচারে হত্যা করা যায়? তাহলে আইন কেন, আদালত কেন? অন্যায়ের প্রতিকারে কি তাহলে আদালতের চেয়ে র‌্যাবের শরণাপন্ন হওয়াই উত্তম পন্থা?
২০০৪ সালের জুন থেকে ২০০৯ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিনা বিচারে নিহত হয়েছে ১৪৬২ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানাচ্ছে, ২০০৯ সালেই নিহত হয়েছে ২২৯ জন। এর মধ্যে নির্যাতনে মরেছে ২৫ জন। পাশাপাশি বিডিআর বিদ্রোহের দায়ে আটক জওয়ানদের মধ্যে ৪৭ জন অসুখে মারা গেছে বলে দাবি করেছে বিডিআর সদর দপ্তর। কিন্তু আটকাবস্থায় ৭০ জনের মৃত্যুর খবর বেরিয়েছে।
অথচ এই আওয়ামী লীগই বিরোধী দলে থাকাবস্থায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, নির্বাচনী ইশতেহারেও ছিল ‘ক্রসফায়ার’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি। সেসব প্রতিশ্রুতি ও কথা কি বুড়িগঙ্গার পানির মতোই দূষিত হয়ে গেছে?
বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ বাংলাদেশে নাগরিক নিরাপত্তা বিষয়ে তাঁর আশঙ্কা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে যদি এমন অবস্থা আসে, যেখানে হাজার হাজার লোক বিনা বিচারে আটক হচ্ছে, হাজার হাজার লোক কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় মারা পড়ছে, সে অবস্থা ঠেকানোর কোনো প্রস্তুতি কি আপনাদের আছে?’ (২৪ জুলাই ২০০৬, সমকাল)। তাঁর আশঙ্কা সত্য হয়েছে, আমাদের কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আইনসম্মত মৃত্যুর অধিকার আজও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। যে দেশে বছরের পর বছর শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যা চলে, সে দেশে বিচার বিভাগের মাথাই-বা উঁচু থাকে কী করে?
এ দেশের মানুষ নদীর পাড়ে, বিলের ধারে, বাঁধের ওপর, সড়ক বা নর্দমার মধ্যে এভাবে গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে থাকতে কখন দেখেছে? প্রকাশ্যে এ রকম ধর্ষণলীলা আমাদের সইতে হয়েছিল আর কখন? একাত্তরের ঘাতকেরা যে অপরাধ বিপুল হারে করেছিল, আজ সেই কাজই কি আরও ছোট মাত্রায় কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলছে না? প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের আক্ষেপ এখনো কানে বাজে, ‘এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত বছরে ৪৪৬টি ধর্ষণের তথ্য মিলেছে, যার মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৬২ জন। ১৫ কোটি মানুষের দেশে সংবাদমাধ্যম কিংবা মানবাধিকার সংস্থার নজরের বাইরে এ রকম আরও অজস্র ঘটনাই ঘটে। অধিকারের আরেকটি প্রতিবেদন বলছে, গত বছর রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৫১ জন নিহত এবং ১৫ হাজার ৫০০ আহত হয়েছে। র‌্যাবের ‘ক্রসফায়ার’ অপরাধ দমন তাহলে কোথায় করল? খুনের তালিকা বাড়ানো ছাড়া তাদের কৃতিত্ব তাহলে কোথায়?
কে অপরাধী আর কে অপরাধী নয়, তা আদালত ঠিক করছেন না, ঠিক করে দিচ্ছে র‌্যাব-পুলিশ। এ জন্যই এর নাম হওয়া উচিত ‘ইচ্ছাখুন’। তাদের চোখে কিছু মানুষের আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। রোমান সাম্রাজ্যের আইনে এই ধরনের মানুষকে বলা হতো হোমো সাসের (Homo Sacer)। হোমো সাসেরদের হত্যায় অপরাধ হতো না, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো বালাই তাদের জন্য খাটবে না। এমনকি তাদের মৃত্যু কখনো মহত্ত্বও পাবে না। তারা জড় বস্তু কিংবা নির্বাক প্রাণীদের মতো অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। এবং তাদের জন্য রাষ্ট্র তৈরি করে রাখবে কিছু প্রতিষ্ঠান, যারা কাজ করে যাবে আইনের আওতার বাইরে, আবার আইনই তাদের দেবে দায়মুক্তি। এর নামই কি আইনের শাসন?
বার আগে সরকার ও রাজনৈতিক সমাজকে স্বীকার করতে হবে যে যা চলছে তা চলতে দেওয়া যায় না। তাদের টনক নড়ানোয় নাগরিক মহলকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এগুলো পতনের লক্ষণ। এখনই যদি দেশময় ছড়ানো সন্ত্রাস-নির্যাতন আর অব্যাহতভাবে চলতে থাকা বিচারবিহীন হত্যা থামানোয় বিরাট ও সাহসী উদ্যোগ না আসে, তাহলে এমন সময় আসবে যখন দুঃখ রাখার জায়গা থাকবে না। সর্বস্তরে যে অপরাধ ঘটছে তার ভয়াবহতা যদি আমরা না বুঝি, তাহলে তা থামাতেও আমরা সক্ষম হব না। যদি বুঝতে না পারি, তাহলে অন্তত জানতে হবে। জানতে হবে এ কারণে যে যা ঘটেছে তা বারবার ঘটতে পারে।
২০ ঘর মানুষের মধ্যে একটি কিশোরীকে একদল বখাটে যুবকের ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে পারা, কিংবা দিনের পর দিন পোশাকধারী বাহিনীর হাতে ভালো-মন্দ নির্বিশেষে মানুষ খুন চলতে পারা আমাদের সার্বিক অবক্ষয়েরই মর্মান্তিক প্রকাশ। গত কয়েক দশকে আমাদের সমাজে অনৈতিকতা ও অশুভ ক্ষমতার বিস্তার এক নৈতিক সুনামির আকার নিয়েছে। এই অশুভেরই চরম প্রকাশ ঘটেছিল রসু খাঁ নামক এক বিকারগ্রস্ত খুনি-ধর্ষকের মধ্যে। কিন্তু নারী নির্যাতন ও আইনি-বেআইনি হত্যালীলা আর সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিস্তার এতদূর পর্যন্ত ঘটেছে যে রসু খাঁকে এখন আর বিশেষ ব্যতিক্রম বলে মনে হয় না। ব্যক্তিগত অশুভ এখন সামাজিক অশুভ হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বড় দলগুলো হয়ে উঠেছে এই অশুভ শক্তির বর্ম, বিভিন্ন বড় পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার হাতিয়ার। এরই চরম প্রকাশ আমরা চারদলীয় জোট সরকারের বিভিন্ন কাজ-কর্মে দেখেছিলাম, এই সরকারের আমলে তার পুনরাবৃত্তি চাই না।
ক্রসফায়ার বন্ধ করা তো দূরের কথা, গত সোমবার রাজধানীতে ‘ক্রসফায়ার’ শীর্ষক দৃকের একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রায়ই সংবাদপত্রে ‘ক্রসফায়ারের’ খবর আর যে রক্তাক্ত লাশের ছবি আসে, সেই ছবি এবং সেই রক্তদর্শনই ‘ক্রসফায়ারের’ সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী, যার আয়োজক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেই। তা কীভাবে তাঁরা বন্ধ করবেন? অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকবে?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.