এইদিনে-শেষের শুরু যেখানে by জাহীদ রেজা নূর

ছাব্বিশে মার্চ ছিল শেষের শুরু। ২৫ মার্চ যখন অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ঢাকা শহর প্রকম্পিত, যখন দাউ দাউ আগুনে জ্বলে যাচ্ছে পত্রিকা অফিস, পিলখানা, রাজারবাগ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্র-শিক্ষক হত্যা চলছে, সারা দেশেই যখন বাঙালিদের হত্যা করার জন্যনেমে গেছে পাকিস্তানি বাহিনী, তখনো ইয়াহিয়া বুঝতে পারেনি, এটা ছিল শেষের শুরু। এটা ছিল একটি দেশের পতন। একটি অহমিকার পতন। একটি নতুন দেশের জন্ম।


যাদের জন্ম হয়েছে স্বাধীনতার পর, যারা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছে পূর্বসূরিদের কাছে, তারা একটু হলেও অস্তিত্বে জড়িয়ে নিয়েছে স্বাধীনতার রং। কিন্তু শত চেষ্টা করলেও তারা সেই সময়টির নাগাল পাবে না। নিজের অস্তিত্ব দিয়ে সে সময়টিকে অনুভব করতে পারবে না। তারা শুধু শুনে যেতে পারবে। কল্পনায় মিশিয়ে নিতে পারবে স্বাধীনতাকে। কিন্তু সেই অসাধারণ মহাকাব্য রচনা করতে পারবে না।
তাদের জন্য রচনা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নামের এক অনবদ্য সংগীতের। সে সংগীতের মূর্ছনাকে কেবল হূদয়ে ধারণই করতে পারবে নতুন প্রজন্ম, কখনোই সৃষ্টি করতে পারবে না সেই সুরলহরী। একটি দেশের জন্ম-যন্ত্রণা যারা স্বচক্ষে দেখেছে, তারা সত্যিই ভাগ্যবান।
আজকের তরুণকে বলা দরকার অপারেশন সার্চলাইটের কথা। ২৫ মার্চ মাঝরাতের পর পাকিস্তানি সেনারা যখন রাস্তায় বেরিয়ে হত্যা করতে লাগল হাজার হাজার বাঙালিকে, তখনই বোঝা গিয়েছিল কী আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ তারা ঘটাচ্ছে। বোঝা গিয়েছিল নির্বাচনে বিজয়ী বাঙালিকে আসলেতারা কী চোখে দেখে। সেই তরুণকে বলা দরকার, ইতিহাসের দিকে একটু তাকাও। যদি নিজেই খুঁজে নিতে না পারো তোমার আত্মপরিচয়, তাহলে একবার হাতে তুলে নাও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র অষ্টম খণ্ড। এ বইটি কারও কারও হাতে তুলে দিয়ে আমি দুবার তাদের মুখাবয়বের দিকে তাকিয়েছি।
বইটি নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় কোনো বাড়তি আগ্রহের ঠিকানা দেখিনি। কিন্তু কিছুটা পড়ার পর যখন তাকে দেখেছি, বুঝতে পেরেছি, সে তখন অন্য মানুষ। বইয়ের পাতায় পাতায় একটি জাতির জন্মের সব যন্ত্রণা বহমান। মানুষের ওপর এতটা অত্যাচার চালানো যায়, তা বিশ্বাস করার জন্য মন তৈরি থাকে না। তাই বইটির একেকটি পৃষ্ঠা যেন রক্তের আখরে লেখা জন্ম-যন্ত্রণার বয়ান। যে পড়বে, সে স্পর্শপাবে স্বাধীনতার। সে বুঝবে, শুধু মুখের কথায় দেশ স্বাধীন হয়নি, এ জন্য কী পরিমাণ আত্মত্যাগ করতে হয়েছিল।
ছাব্বিশে মার্চ কি বোঝা গিয়েছিল,
নয় মাস পর সত্যিই বিজয় নিশান উড়বে মাথার ওপর? শামসুর রাহমানের কবিতার পঙিক্তগুলোয় একটু স্থিত হই আমরা, ‘গ্রাম্যপথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরু/ নেই কোন, রাখাল উধাও, রুক্ষ সরু/ আল খাঁ খাঁ, পথপার্শ্বে বৃক্ষরা নির্বাক;/ নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক। (কাক, শামসুর রাহমান, বন্দী শিবির থেকে)। কী এক বিরানপ্রান্তরে পরিণত হয়েছিল দেশ!
আজকের তরুণ অনেক বেশি সচেতন। তারুণ্য সব সময় সজীব। তাদের ভেতর শুধু ঢুকিয়ে দিতে হয় ভাবনা, সেই ভাবনার হাত ধরে তারা নিজেরাই যেতে পারে এগিয়ে। তাই সেই জ্বলন্ত ভাবনা যদি তারা একান্ত আপন করে নেয়, তবে তাদের কাছে একাত্তর কখনোই কেবল অতীতের বিষয় হবে না। তারা জানে, এই গৌরবময় ইতিহাসের পথ ধরেই রয়েছে ভবিষ্যতের মুক্তির ঠিকানা।
এই তরুণেরা জানে, কত লাখ মানুষ স্রেফ বাঙালি হওয়ার অপরাধে শহীদ হয়েছেন। ওরা জানে, কত লাখ নারী স্রেফ বাঙালি হওয়ার অপরাধে হয়েছেন নির্যাতনের শিকার। ওরা জানে, একটি স্বপ্ন কীভাবে পরিণত হয় বা০স্তবে এবং মুক্তির আনন্দে কী করে ভেসে বেড়ানো যায় আকাশে।
একাত্তর তাই অনেক দূরের এবং অনেক কাছের। আমরা ভাগ্যবান, এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে জীবিত দেখতে পাই। আমরা ভাগ্যবান, যাঁরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, তাঁরা এখনো বেঁচে আছেন। কেটে যাবে আরও এক বা দুই দশক। তখন কেউ আর ইতিহাসের সাক্ষীদের দেখতে পাবে না। তাই যে তরুণ আজ মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে, তারাও কোনো না কোনোভাবে সেই অসাধারণ সময়টিকে পাচ্ছে নিজের করে। এ জন্য তাকে ঈর্ষা করবে পরবর্তী প্রজন্ম।
এ দেশের ওই গর্ব করার মতো অতীতে রয়েছে খানিকটা কালি। আমাদের দেশেরই কিছু দালাল তখন পাকিস্তানিদের স্বার্থ হাসিলের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। ওরা নির্বিচারে হত্যা করেছে বাঙালিদের। কাক নাকি কাকের মাংস খায় না। ওরা বাঙালি হয়ে পাকিস্তানিদের পায়ের কাছে নতজানু হয়েছে এবং হত্যা করেছে অন্যবাঙালিদের।
তরুণেরা জানে, বিশ্বাসঘাতকতার জন্য থাকে বড় শাস্তি। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও দেখতে চায়। তরুণদের মানববন্ধনগুলো তাই আশাবাদী করে মানুষকে।
স্বাধীনতা দিবস আজ। ঘরে ঘরে দুর্গগড়ে তোলার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল বাঙালি। যুদ্ধের তালিম নিয়েছিল। জড়িয়েছিল সম্মুখসমরে। সেসব ইতিহাসের দেখা মিলবে মুক্তিযুদ্ধের বইগুলোতে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণায়।
একটি বিজয় নিশান কত বড় করে তুলতে পারে একটি জাতির হূদয়কে! সেই নিশান ঠিকভাবে বহন করতে পারলেই গর্ব টিকে থাকে যুগের পর যুগ। আজ সারা দেশে পত্ পত্ করে উড়ছে যে বিজয় পতাকা, তার সঙ্গে উড়ুক আমাদের মন। চেতনায় ধরা দিক স্বাধীনতা। ধরা দিক সত্যিকারের বিজয়।

No comments

Powered by Blogger.