সিলেটের নাহার পুঞ্জি-চার হাজার গাছের জীবন বাঁচাতে by পাভেল পার্থ

২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস পালনের মাত্র এক মাস আগে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার নাহার চা-বাগানের কাইলিন (নাহার-২) ও আসলম (নাহার-১) খাসিয়া পানপুঞ্জির জীবনদায়িনী চার হাজার গাছের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ হাইকোর্ট। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার হাজার গাছের ভেতর অধিকাংশই চাম, গামার,


গর্জন, জাম, কড়ই, বনাক, রঙ্গি, শিমুল, আওয়াল, খামি, লুদ, বেলপই, ডুমুরের মতো প্রাকৃতিক বনভূমি বাস্তুসংস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব বিপন্নপ্রায় বৃক্ষপ্রজাতি।
দেশের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বর্ষারণ্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কাছাকাছি অবস্থিত নাহার চাগান-কাইলিন-আসলম খাসিয়া পানপুঞ্জি এলাকাটি এককালে প্রাকৃতিক বর্ষারণ্যের অংশ থাকলেও করপোরেট চা-বাণিজ্য প্রসারের জন্য এখানকার বনভূমি সমূলে উপড়ে ফেলা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই চার হাজার গাছ নিজের শরীরে ধরে রেখেছে স্থানীয় খাসিয়া ও চা-বাগানের আদিবাসীদের বেঁচেবর্তে থাকার জীবন রসদের অনেক কিছু। পানচাষি খাসিয়াদের গাছপান চাষের জন্য এই গাছগুলো ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ লতানো খাসিয়া গাছপান এসব দেশীয় বৃক্ষপ্রজাতিকে আশ্রয় করেই বেড়ে ওঠে। খাসিয়া পানজুম এবং যাপিত জীবনের কোনো ধরনের বিবেচনা ছাড়া এভাবে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত যেন ফসল রেখে ফসলের জমি কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনা।
যদি চার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয় তবে তা কেবল খাসিয়া-মান্দি বা চা-বাগানের আদিবাসী ও দরিদ্র বাঙালিদের জন্যই হুমকি হবে না, একই সঙ্গে তা বিপন্ন করে তুলবে স্থানীয় এলাকার এসব পাখি-পতঙ্গসহ অপরাপর বন্য প্রাণীকেও। যারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে এই চার হাজার গাছ ও বৃক্ষবেষ্টনীর বাস্তুসংস্থানের ওপর নির্ভরশীল। ১৪ মার্চ ২০১০ তারিখে ডেইলি স্টার, ১৭ মার্চ ২০১০ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পাতায় নাহার চা-বাগানের খাসিয়া পানপুঞ্জি এলাকার গাছ হত্যার এসব নির্মম ছবি ছাপা হয়েছে। হাইকোর্টের বিচারক মো. মমতাজউদ্দীন আহমেদ এবং নাঈমা হায়দার প্রতিবেশ-বাস্তুসংস্থান-আদিবাসীদের বননির্ভরশীলতাকে কোনো ধরনের বিবেচনায় না এনেই ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে চার হাজার গাছের এই মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন।
২০০৮ সালের ৩০ জুন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নাহার চা-বাগানের খাসিয়া পানপুঞ্জি এলাকার গাছ কাটার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেয়। ৭ আগস্ট ২০০৮ তারিখে ৪৭ লাখ ৫১ হাজার ৩৯১ টাকা রাজস্ব নির্ধারণ করে নাহার চা-বাগানের বিভিন্ন প্রজাতির চার হাজার গাছ কাটার অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ বন বিভাগ। রাষ্ট্রের অনুমোদন পেয়ে নাহার চা-বাগান কর্তৃপক্ষ দেড় কোটি টাকায় গাছগুলো বিক্রি করে দেয়। ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ থেকে গাছ কাটা শুরু হলে বিষয়টি দেশব্যাপী মনোযোগ তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে ১৯ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গাছ কাটার অনুমোদন বন্ধ করে। সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন ২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে আবারও খাসিয়াপুঞ্জির ৪৫০টি গাছ বাদে দুই হাজার ৩৫০টি গাছ কাটার প্রশ্নহীন অনুমতি দেন মেসার্স সালিম ট্রেডার্সকে। ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও গাছ কাটার পক্ষে সাম্প্রতিক রায় ঘোষণা করেন।
ইতিমধ্যে চার শতাধিক গাছ চলে গেছে করাতকলে। ১৯৭৩ সালে গৃহীত বিপন্ন বন্য প্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রজাতির বাণিজ্য-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ (Convention on International Trade in Endangered Species of wild fauna and flora/CITES) অনুযায়ী যেসব প্রাণবৈচিত্র্য এই সনদের অন্তর্ভুক্ত সেসবের কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা আজও বাংলাদেশে নিশ্চিত করা হয়নি। নাহার চা-বাগান এলাকায় বিরল ও বিপন্নপ্রায় বৃক্ষপ্রজাতিকে কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে হত্যার জন্য রাষ্ট্র যে অনুমোদন দিয়েছে তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ-প্রাণবৈচিত্র্য সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিকে লঙ্ঘন করেছে। বন বিভাগ কেবল চার হাজার গাছের কাঠ ও জ্বালানি মূল্য হিসাব করে এর মোট মূল্য নির্ধারণ করেছে দেড় কোটি টাকা। কিন্তু এই গাছগুলো খাসিয়াদের পান চাষে যে সহায়তা করে তার সরাসরি একটা কৃষি অর্থনৈতিক ভিত আছে, যা বন বিভাগ হিসাবে আনেনি। এই গাছগুলো স্থানীয় এলাকার বর্ষারণ্য প্রতিবেশ তৈরি করেছে। এখানেই জন্মে স-পলেংসিয়া, ক্রা-বনহের, ক্রা-লেহিড, ক্রা-উমর, ক্রা-দে, সহ-লেতেরা, ক্রা-পেদে, স-লারহু, ড-পেনচুং, ক্রা-সিয়াংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ লতাগুল্ম। একটি বাস্তুসংস্থানের কোনো প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন বা রক্তাক্ত করলে সেই বাস্তুসংস্থানের খাদ্যশৃঙ্খল থেকে শুরু করে পারস্পরিক জটিল প্রতিবেশীয় সম্পর্ক সবকিছুই তছনছ হয়ে পড়ে। এ কথা রাষ্ট্রকে কে বোঝাবে? যেখানে চার হাজার গাছের জীবনের দাম মাত্র দেড় কোটি কাগুজে টাকায় হিসাবনিকাশ করা হয়।
বন বিভাগ যখন চার হাজার গাছের বাজারমূল্য হিসাব করেছে তখন এই চার হাজার গাছকে ঘিরে পুরো এক বাস্তুসংস্থানের জটিল সম্পর্ককে বিবেচনা করেনি। এটি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গিগত মনোজাগতিক সমস্যা। বন বিভাগ, কাঠব্যবসায়ী ও রাষ্ট্রকে এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। বনভূমি, প্রতিবেশ রক্ষায় স্থানীয় জনগণের দর্শন ও জীবনযাপনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক থেকে শিক্ষা নিয়ে হাইকোর্টকেও প্রাণসম্পদের যাপিত জীবনের পক্ষে আইনগতভাবে দাঁড়াতে হবে। জলবায়ু বিপন্ন এ সময়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এ চার হাজার গাছও আমাদের বেঁচেবর্তে থাকাকে নিশ্চিত করছে দিনরাত নিজেকে রক্তাক্ত করেই। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিহত প্রায় এক হাজার ৬০০ গাছের স্মৃতির প্রতি নতজানু হয়ে এখনই আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আশা করি, গাছ কাটার সব ধরনের অনুমোদন বাতিল করে নাহার চা-বাগান এলাকার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার হাজার গাছকে বাঁচাতে রাষ্ট্র সত্যিকারের ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। আজই, এখনই।
পাভেল পার্থ: প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য-বিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.