গার্মেন্ট শিল্পে অসন্তোষ-এই অশুভ তৎপরতা বন্ধ হোক

গত শনিবার সাভারে গার্মেন্ট শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় গাড়িচাপা পড়ে এক গার্মেন্ট শ্রমিক নিহত এবং পুলিশসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। এক আহত পুলিশের শটগান খোয়া গেছে। সংঘর্ষকালে বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে।


এলাকায় ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অনেক কারখানায় তাৎক্ষণিকভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। এসব কিসের আলামত? চীন ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প যখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে, তখন সামান্য ঘটনা নিয়ে এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বিশেষ ইঙ্গিতবহ নয় কি? জানা যায়, কর্মকর্তার সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কারণে হা-মীম গ্রুপের একটি কারখানার এক শ্রমিককে গত বৃহস্পতিবার পুলিশে দেওয়া হয়েছিল। এদিকে রটিয়ে দেওয়া হয়, সেই শ্রমিককে মেরে লাশ গুম করা হয়েছে। এতে শুধু হা-মীম গ্রুপই নয়, আশপাশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোর শ্রমিকরাও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং শনিবার সকাল থেকে আটক শ্রমিকের মুক্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় বেশ কিছু গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। পুলিশ বাধা দিতে গেলে শুরু হয় শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ। এ ঘটনা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, ভাবনারও বিষয়।
গার্মেন্ট শিল্পের এমন পরিস্থিতি শুধু সাভারেই নয়, আরো কিছু জায়গায় ঘটেছে। বিশেষ করে দেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়, তখনই দেখা যায়, গার্মেন্ট শিল্পেও এর প্রভাব পড়ছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, তাহলে রাজনীতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যই কি গার্মেন্টকে কোনো শক্তি ব্যবহার করছে? শ্রমিক অসন্তোষের প্রকাশ্য কারণগুলো বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়, সহজে মীমাংসাযোগ্য কারণেও প্রাণহানি কিংবা রাস্তা অবরোধ বা গাড়ি ভাঙচুর করার মতো ঘটনা ঘটে, যা মোটেও কাম্য নয়। শ্রমিকদের পাওনা আদায় করার জন্য মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনার অবকাশ আছে। যেকোনো বড় সমস্যা সমাধানের জন্যও ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার সুযোগ আছে। কিন্তু উৎপাদনব্যবস্থায় প্রযোজ্য মাধ্যমগুলো বাদ দিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে এই অসহিষ্ণুতা কেন আসে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
বাংলাদেশের এই খাতটি বিশ্বে এখন উল্লেখযোগ্য অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। দেশের ২৫ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বিধানেও বড় ভূমিকা রাখছে। বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুবাদে সামাজিক সুপরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। অথচ তার পরও এই শিল্পে অসহিষ্ণু পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে কেবলই শ্রমিকরা বঞ্চিত হওয়ায়? আইনি দুর্বলতা, মালিক শ্রেণীর অতি মুনাফার লোভ কিংবা প্রতিকূল পরিবেশ, কোন কারণটি সর্বাধিক কাজ করছে?
সুষ্ঠু শ্রম-পরিবেশ সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে শ্রম আইন। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রম আইনের দুর্বল কাঠামো উৎপাদনশীলতাকে কমিয়ে এনেছে এবং এই খাতে অসন্তোষকে উসকে দিচ্ছে। তাই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং সুষ্ঠু শ্রম-পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনে প্রচলিত শ্রম আইনকেও যুগোপযোগী করা অপরিহার্য। বিশেষ করে দেশের বৃহৎ শিল্প খাত গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিক স্বার্থ উপেক্ষিত হয় বলে যেভাবে দেশের বাইরে প্রচার হচ্ছে, তা কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা এ মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। শ্রম পরিবেশ এবং শ্রমিকের স্বার্থ বিঘি্নত করে উৎপাদনকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেওয়া সম্ভব হয় না। এটা আধুনিক উৎপাদনব্যবস্থাপনায় স্বীকৃত হলেও এ দেশে তার প্রতি নজর দেওয়া হয় খুবই কম। বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে মালিক শ্রেণীর অনীহা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে। এসব বিবেচনা করে সরকার শ্রম আইন-২০০৬ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে গার্মেন্ট কারখানাগুলোর মালিকরা। দুর্মূল্যের বাজারে একজন শ্রমিকের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার চাহিদা পূরণ করা না হলে সেই শ্রমিক কি কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনমাত্রা পূরণ করতে পারবেন? সেই চাহিদা পূরণ করার জন্য শ্রমিকদের যৌথ দর কষাকষির সাংগঠনিক সুবিধাও এখানে অনুপস্থিত। এমন পরিস্থিতিতে আইনও যদি তাঁদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত না করে, তাহলে এই খাতে উচ্ছৃঙ্খল অবস্থা বৃদ্ধি পাবে। গার্মেন্ট শিল্প খাতে অসন্তোষ কমিয়ে আনার জন্য সরকার, শিল্প মালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতা বৃদ্ধি করতে হবে। অসন্তোষের কারণ নির্ধারণ করে তা নিরসন করতে হবে দেশের স্বার্থেই।

No comments

Powered by Blogger.