মত দ্বিমত-যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারি উন্নয়ন by গওহর রিজভী

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তাঁর এ সফর বিশ্লেষণ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী এবং বিএনপির সহসভাপতি ও চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক সমন্বয়কারী শমসের মবিন চৌধুরী


মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক দ্বিধা থাকলেও গত চার দশকে অভিন্ন মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে নিবিড় ও অংশীদারিমূলক সম্পর্ক স্থাপনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আমাদের মতের কোনো অনৈক্য নেই, যদিও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উভয় দেশেরই নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ আছে। এ সত্ত্বেও আমাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় এবং প্রগাঢ়। এই সম্পর্ক পারস্পরিক গভীর শ্রদ্ধা ও বিবিধ লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র বহুদলীয় গণতন্ত্র, বৈচিত্র্য, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতা চর্চায় এবং গণতন্ত্রের মননভূমি হিসেবে সক্ষম ও সক্রিয় সুশীল সমাজের বিকাশে অঙ্গীকারবদ্ধ। নিঃশর্তভাবে মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা চর্চার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র আপসহীন। আর এসব মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মঞ্চে এই দুই দেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে; তারা জাতিসংঘের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং নিপীড়ন, বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধেরও চেষ্টা করছে।
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অনুকরণীয় পথপ্রদর্শক। সামাজিক ন্যায়বিচার ও নারীর ক্ষমতায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ একটি মধ্যপন্থী, প্রগতিশীল, উদার গণতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল ও ইসলামি দেশগুলোর জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত। যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগের প্রশংসা করে। এ সম্পর্ক বিশেষভাবে প্রতিভাত হয় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পররাষ্ট্রনীতির অনেক অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বীকৃতি ও উল্লেখ থাকে। বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর শক্তিশালী অথচ সংযত কণ্ঠস্বর সদা সোচ্চার। এ বিষয়ে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গেও নিজের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রভাব, সংযত ভূমিকা ও অর্জিত সুনাম দিয়ে জলবায়ুর পরিববর্তনজনিত ভয়াবহতা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা, বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসুবিধা, ইসলামি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত বিষয়গুলো মার্কিন প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের বিষয়। আর এ ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ যে যুক্তরাষ্ট্রের ভালো সহযোগী, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অনেক দেশেই উন্নয়ন সহায়তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বাংলাদেশে এই সহযোগিতা ক্রমাগত বেড়েছে, বিষয়টি নিশ্চয়ই পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এড়ায়নি। খাদ্য, জ্বালানি, পানি ও পরিবেশসংক্রান্ত সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পথিকৃৎ ও মডেল হিসেবে প্রশংসা করে মার্কিন সরকার। উপ-আঞ্চলিক উন্নয়ন প্রকল্পে কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতার ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের প্রস্তাবে সেটিই প্রকাশ পেয়েছে। গত তিন বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্তাব্যক্তি এবং ব্যবসায়ী বাংলাদেশ সফর করেছেন। এর আগের ১০ বছরের তুলনায় এই সংখ্যা অনেক বেশি এবং এই সংখ্যাবৃদ্ধি নেহাতই আকস্মিক ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। হিলারি ক্লিনটনের সফরকেও এই অঙ্গিকে দেখা উচিত হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারির বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্তটা এমন সময়ে নেওয়া হলো, যখন পুরো যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার নিয়ে সরব। এ রকম ব্যস্ত সময়ে এই সফর ইঙ্গিত করে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারি ও সহযোগিতার সম্পর্ককে কতটা গুরুত্ব দেয়। হিলারির এই সফর দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পুরো বিষয় পর্যালোচনা করতে এবং আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিপাত করতে সহায়তা করেছে।
দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের অংশীদারি সংলাপের জন্য যৌথ ঘোষণা সই হয়েছে; যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ব্যবস্থা ভারত ও চীনের সঙ্গেও আছে। যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরের এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। এটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, অর্থপাচার রোধ (মানি লন্ডারিং), সামরিক প্রশিক্ষণ, বাণিজ্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের বিদ্যমান সহযোগিতা আরও জোরদার করবে।
আমাদের আলোচ্যসূচিতে এমন অনেক বিষয়ই ছিল, যা পুরোপুরি সমাধান হয়নি; আর এ নিয়ে লুকোচুরি করার কিছু নেই। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা-সংক্রান্ত টিকফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম) চুক্তির প্রধান বিষয়গুলোর ব্যাপারে দুই দেশই একমত হয়েছে। তবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আমাদের আরও কিছু সময় প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের কিছু পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে মার্কিন সফরকারী দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, যাতে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা আমরা কমাতে পারি। এ ব্যাপারে সার্বিক সিদ্ধান্ত নেবে মার্কিন কংগ্রেস; তবে আমরা এটা ভেবে আশ্বস্ত, বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার জন্য আমরা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে পাশে পেয়েছি। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সূচকে আমাদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ভিত্তিতে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়েছি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে বক্তব্য তুলে ধরার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
আমাদের নিজেদের যোগাযোগ-সংক্রান্ত অক্ষমতার কারণেই হয়তো এ দেশের বলিষ্ঠ ও স্বাধীন গণমাধ্যম হিলারির এই সফরের প্রকৃত মর্মার্থ ও প্রাপ্তি যথার্থভাবে তুলে ধরতে পারেনি। তারা মূলত দৃশ্যমান বিষয়গুলোর প্রতি মনোনিবেশ করেছে। তাদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পরামর্শের কথা তুলে ধরেছে। প্রকৃত বিষয় হলো, দুটি সার্বভৌম দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয় না। আমরা অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করিনি। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর বৈঠকের সময় অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কিছু বলেছেন কি না, সে ব্যাপারেও আমরা অবহিত নই। দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার অংশ হিসেবে আমাদের বিভিন্ন উদ্যোগ বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছি। ভোটাররা যাতে কোনো ধরনের ভয়-ভীতি ছাড়া তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংলাপের যে আহ্বান জানিয়েছেন, সেটা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও সম্পূর্ণ মিলে যায়। কোনো দল যাতে নির্বাচন বর্জন না করে, সে ব্যাপারে হিলারির আহ্বানকে আমরাও স্বাগত জানাই।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক নিয়ে গণমাধ্যমের বাড়তি আগ্রহ থাকাটা বিস্ময়ের কিছু নয়। গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়টি সামনে এনে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ বোঝাতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের চার দশকের বেশি সময়ের বহুমাত্রিক সম্পর্কে চিড় ধরেছে। অধ্যাপক ইউনূস যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পাশাপাশি দেশেও অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন, সে বিষয়টি প্রশ্নাতীত। একই সঙ্গে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক আছে। তবে শুধু এই একটি মাত্র বিষয় দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কেন্দ্র, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। হিলারি ক্লিনটন ক্ষুদ্রঋণ-ব্যবস্থার ব্যাপারে ভীষণ উৎসাহী। গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে আরও জানার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী। গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সত্যটা হলো—তাদের ঋণের পরিমাণ কমেনি, ঋণ আদায়ের হার আগের মতোই আছে এবং মূলধন সরিয়ে নেওয়ার বা ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনাই নেই। সব তথ্যই হিলারি জানেন। প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ বিষয়টি আমাদের আলোচনায় এসেছে, কোনো নির্দিষ্ট নাম নিয়ে কথা হয়নি।
যেকোনো বিবেচনায় হিলারির এই সফর সফল। ‘এটি আমাদের প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে’—এই সফর সম্পর্কে একজন মার্কিন কর্মকর্তার মন্তব্য ছিল এমন। আমাদের উচিত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারির সাফল্য উদ্যাপন করা এবং পারস্পরিক স্বার্থে আমাদের সম্পর্ক কীভাবে আরও গভীর করা যায়, সেদিকে মনোনিবেশ করা। মূল প্রসঙ্গ লঘু করে আপাতদৃশ্যমান বিষয়গুলো আতশ কাচ দিয়ে বড় করে দেখানো বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
গওহর রিজভী: প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা।

No comments

Powered by Blogger.