বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৯৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল গফুর, বীর প্রতীক সাহসী দলনেতা সকালবেলায় আবদুল গফুরের অবস্থান ধলাপাড়ার কাছাকাছি গোলাগুলির শব্দ। তিনি বুঝতে পারলেন আশেপাশে কোথাও পাকিস্তানি সেনারা এসেছে। আবদুল গফুর মুক্তিযোদ্ধা।


তাঁর সঙ্গে আছেন ৪০-৪৫ জন সহযোদ্ধা। দলনেতা তিনি নিজেই। ভাবলেন পাকিস্তানিদের অতর্কিতে আক্রমণের সুযোগ পাওয়া গেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
খোঁজ নিয়ে আবদুল গফুর জানতে পারলেন, পাকিস্তানি সেনারা তাঁর অবস্থানের উত্তর দিকের রাস্তা দিয়ে সামনের দিকে গেছে। কয়েক মাইল পর ওই রাস্তা শেষ। পাকিস্তানিদের আবার ফিরে আসতে হবে ওই রাস্তা দিয়েই। সেটা বুঝে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে অবস্থান নিলেন ওই রাস্তায়। ধলাপাড়ার কাছে মাকড়াইয়ে। সেখানে তিনি অপেক্ষা করতে থাকলেন শত্রুদের জন্য।
আবদুল গফুরের হিসাবে ভুল হলো না। বেলা আনুমানিক একটা। খবর পেলেন শত্রু সেনারা ওই পথ ধরে ফিরে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজ চোখেই তাদের দেখতে পেলেন। কোথাও কোনো বাধা না পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা বেশ নিশ্চিন্ত মনেই আসছে। সেনা ও সহযোগী রাজাকার মিলে সংখ্যায় তারা কম নয়। আবদুল গফুরের মনে হলো তাঁদের চেয়েও বেশি।
আবদুল গফুর এতে বিচলিত হলেন না। তিনি জানেন আশপাশে আছে তাঁদের আর একটি দল। খবর পেলে তারাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেবে। যদি নাও আসে তাহলেও ক্ষতি নেই। যদি পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা আক্রমণ করে তিনি তাঁর দল নিয়েই তাদের মোকাবিলা করবেন। সহযোদ্ধাদের সাহস দিয়ে বললেন, পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পাবে না। জান বাঁচাতে পালাতে থাকবে। আরও বললেন, তিনি সংকেত দেওয়ার আগে কেউ যেন গুলি না করেন।
অল্পক্ষণের মধ্যে শত্রু পাকিস্তানি সেনা আর রাজাকাররা আবদুল গফুরের দলের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের আওতায় চলে এল। তিনি সংকেত দেওয়া মাত্র তাঁর সহযোদ্ধারা একযোগে গুলি শুরু করলেন। নিমিষে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার। বাকিরা ছোটাছুটি শুরু করে দিল। রাজাকাররা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। ঘটনাচক্রে কাদেরিয়া বাহিনীর সামরিক প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকীও (বীর উত্তম) কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ সেদিন মাকড়াইয়ের কাছাকাছি ছিলেন। তিনিও ওই যুদ্ধে অংশ নেন।
সেদিন মাকড়াইয়ের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কয়েকজন নিহত ও অনেক আহত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলে। এরপর পাকিস্তানি সেনারা নিহত ব্যক্তিদের ফেলে এবং আহতদের নিয়ে পালিয়ে যায়। মাকড়াই টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার অন্তর্গত। এ ঘটনা ঘটে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি বা তার কয়েক দিন পর।
আবদুল গফুর চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে। সে সময় ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। পরে কাদেরিয়া বাহিনী গঠিত হলে এতে যোগ দেন। তাঁকে একটি দলের নেতৃত্ব দেওয়া হয়। ভূঞাপুর, ধলাপাড়া, দেওপাড়া, বল্লাসহ আরও কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল গফুরকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪১৬।
আবদুল গফুর স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীর চাকরিতে আর যোগ দেননি। বর্তমানে কৃষি কাজ করে সংসার চালান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার বাসাইল উপজেলার কাউলজানী গ্রামের চরপাড়ায়। তাঁর বাবার নাম গজনভী মিয়া। মা বাছাতন বেগম। স্ত্রী লাইলি বেগম। তাঁদের দুই মেয়ে, চার ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ইকবাল গফুর এবং মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবীর বাঘা সিদ্দিকী, সুনীল কুমার গুহ।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.