মত দ্বিমত বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ে দুর্নীতি দমনের পরিস্থিতির বিষয়ে দুটি লেখা ছাপা হলো-দুর্নীতির বিস্তার মোটেই কমেনি by এম হাফিজউদ্দীন খান

নবম সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার এসেছে এবং তাদের কার্যকাল ইতিমধ্যে সোয়া এক বছর পার হয়ে গেছে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে দুর্নীতি দমন ছিল অন্যতম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময় একাধিকবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।


কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি কী? দুর্নীতির প্রকোপ কমেছে? এ বিষয়ে হয়তো কোনো গবেষণা এখনো করা হয়নি। তবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত অসংখ্য ঘটনা এবং ভুক্তভোগী জনসাধারণের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে পরিষ্কার বোঝা যায়, দুর্নীতির বিস্তার মোটেই কমেনি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে খোলাখুলিভাবে দুর্নীতি হচ্ছে। যেমন— টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য ইত্যাদি। এই দুর্নীতির পেছনে রাজনৈতিক সমর্থন আছে কি না, তা পরিষ্কারভাবে বোঝা না গেলেও এগুলো বন্ধের ব্যাপারে সরকারি তৎপরতার অভাব স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে।
বার্লিনের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পরিচালিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে সর্বশেষ সমীক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থানের একটি উন্নতি হয়েছে ঠিকই—সর্বনিম্ন অবস্থান থেকে বর্তমানে ১৩ নম্বরে স্থান পেয়েছে। তবে স্কোর হয়েছে ১০-এর মধ্যে ২ দশমিক ৪। স্কোর তিন হলে ধরা হয়, দুর্নীতি দমনে সে দেশ মোটামুটি তৎপর। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা আশা তৈরি করেছিল ঠিকই কিন্তু বর্তমানে সরকারি ক্রয় নীতিমালায় যে ধরনের সংশোধনী আনা হচ্ছে, তাতে সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। বিশেষ করে লটারির মাধ্যমে কার্যাদেশ বা ক্রয়াদেশ দুর্নীতির সুযোগ অবশ্যই বাড়িয়ে দেবে।
স্মরণযোগ্য যে দুর্নীতি দমনের জন্য সরকারের যে সংস্থা আগে ছিল অর্থাৎ দুর্নীতি দমন ব্যুরো, তা দুর্নীতি দমনে একেবারেই অকার্যকর ছিল। শুধু তাই নয়, খোদ ওই সংস্থার বিরুদ্ধেই ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। ওই সংস্থার অকার্যকারিতার একটি বড় কারণ ছিল সংস্থার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্নীতির মামলা রুজু করার জন্য সরকারের (রাষ্ট্রপতির শাসনের অধীনে রাষ্ট্রপতির ও পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর) পূর্বানুমতি গ্রহণের বাধ্যবাধকতা। এমনও দেখা গেছে, ব্যুরোর পাঠানো মামলার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য ছয়-সাত বছর পর্যন্ত পড়ে ছিল। এবং অনুমোদন আদৌ দেওয়া হবে কি না, তা ছিল অনিশ্চিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুমোদন কেন দেওয়া হবে না, তা সংস্থাকে জানানো হতো না।
এসব কারণে এবং বিশেষ করে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ পরপর পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দুর্নীতি দমন ব্যুরোর পরিবর্তে একটি শক্তিশালী এবং স্বাধীন দুর্নীতি দমন সংস্থা গড়ার তাগিদ জোরালোভাবে অনুভূত হয়। এ বিষয়ে দেশের চিন্তাবিদ, বিভিন্ন সংস্থা ও দাতা সংস্থা সরকারের এ ধরনের একটি সংস্থা স্থাপনের জন্য চাপ প্রয়োগ করে; যার ফলে বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু গোড়াতে, বিশেষ করে বিএনপির শাসনামলে ওই সংস্থা এর পূর্বসূরির মতো বিভিন্ন কারণে অকার্যকর ছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল সরকারের সহায়তা ও সমর্থনের অভাব। পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কমিশন পুনর্গঠন করা হয়। কমিশনকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং তাদের সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা হয়। কমিশন যথেষ্ট তৎপরতা দেখায় এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বহু মামলা দায়ের করে। তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে কমিশনের বিরুদ্ধে অতি তৎপরতার অভিযোগও রয়ে গেছে। এর কারণ তদানীন্তন সরকারের দায়বদ্ধতার অভাব এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে কিছু মামলা দায়ের করার জন্য কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করা। এই কাজটি তখনকার সরকার করেছিল ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটির মাধ্যমে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কমিশনের চেয়ারম্যান বদল করা হয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান একজন সত্ ও দক্ষ আমলা, সন্দেহ নেই। কিন্তু কমিশনের তৎপরতার অভাব স্পষ্টতই পরিলক্ষিত হচ্ছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অনেকটাই স্থবির হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা যায়, যা কমিশনের খোদ চেয়ারম্যান নিজেও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। প্রথমত, দুর্নীতি মামলার বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। এ সমস্যার সমাধান কমিশনের আওতাভুক্ত নয়। এটা আমাদের বিচারপ্রক্রিয়ার বিশেষ করে উচ্চতর আদালতের সংস্কারের ওপর নির্ভরশীল। এই বিষয় নিয়ে অনেক সময় গুণীজনেরা অনেক মন্তব্য ও সুপারিশ করেছেন। কিন্তু কার্যত বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ত, চেয়ারম্যান বলেছেন, আমাদের দেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়া দুর্নীতির একটি উৎস। এখানে কমিশনের হয়তো কিছুটা ভূমিকা আছে। তবে বৃহত্তর আঙ্গিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যত ত্রুটি-বিচ্যুতি বিরাজমান, যেমন—অর্থের ছড়াছড়ি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি কমানোর জন্য নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন আইনের সংস্কার ও বাস্তবায়ন করা মুখ্য। তদুপরি দেশে বিরাজমান কলুষিত রাজনৈতিক কৃষ্টির পরিবর্তনও অত্যন্ত জরুরি। তৃতীয়ত, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই বলেছিল, দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা হবে এবং এ জন্য একটি কমিটিও কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু কমিটির সুপারিশগুলো কমিশনকে সবল করার পরিবর্তে আরও দুর্বল করতে যাচ্ছে, যা চেয়ারম্যান নিজেই বারবার বলেছেন। এখানে তিনটি বিষয় উল্লেখযোগ্য: প্রথমটি হলো, সরকারি আমলা ও রাজনৈতিক পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করতে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বিধান পুনর্বহাল করা। যদি তাই করা হয়, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন এর পূর্বসূরি অর্থাৎ দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে পর্যবসিত হবে। পূর্বানুমোদন গ্রহণের কোনো যৌক্তিক কারণ আছে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে না। আমলা বা রাজনৈতিক পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার ব্যাপারে কমিশন নিজেই মামলার জন্য সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে দেখবে। সুতরাং পুনরায় সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এতে কমিশনের কার্যকলাপ প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে এবং দুর্নীতিবাজদের মনে কমিশনের যে আতঙ্ক ছিল, তা আর থাকবে না। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে কমিশন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। স্মরণযোগ্য যে আমাদের দেশে চলছে মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত সরকার, যেখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা মানেই হলো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা। যে দেশে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অহরহ শোনা যায়, এমনকি কোনো কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ আসে, সেখানে কমিশনকে রাষ্ট্রপতির তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ করা মানেই হলো কমিশনকে কার্যত অকার্যকর করা। কমিশনের দায়বদ্ধতা সংসদের কাছে করা যেতে পারে। সংসদের কোনো একটি স্থায়ী কমিটিকে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এবং সেটাই বোধহয় সর্বোত্তম সমাধান। তৃতীয়ত, কমিশনের সচিব নিয়োগ এবং তাঁকে প্রিন্সিপাল একাউন্টিং অফিসার নির্ধারণ করার অর্থই হলো কমিশনের ভেতরে সরকারের একজন শক্তিশালী এজেন্ট স্থাপন, যিনি সরকারের ইশারা-ইঙ্গিত অনুসারে কাজকর্ম করবেন। কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রিন্সিপাল একাউন্টিং অফিসার করলে দোষের কী? দুর্নীতি দমন কমিশনের হিসাব মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের আওতাধীন এবং অর্থের কোনো অপব্যয়, অপচয় বা দুর্নীতি হলে তিনি অডিট রিপোর্টের মাধ্যমে তা সংসদে পেশ করবেন এবং সরকারি হিসাবসম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অর্থাৎ পাবলিক একাউন্টস কমিটির কাছে কমিশনের চেয়ারম্যানকে জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং কমিশনের সচিবকে প্রিন্সিপাল একাউন্টিং কর্মকর্তা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
সার্বিকভাবে বলতে গেলে, ওপরে বর্ণিত তিনটি প্রস্তাব কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতার মূলে কুঠারাঘাত করবে। এহেন পরিস্থিতিতে দেশে দুর্নীতির প্রকোপ কমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং দুর্নীতি যে বেড়েই চলছে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। দুর্নীতি দমনের জন্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী সংস্থার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। সেটা অস্বীকার করা হলে বা এ ধরনের সংস্থাকে বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে রাখলে দেশে দুর্নীতির বিস্তার রোধ করার আকাঙ্ক্ষা আকাঙ্ক্ষাই থেকে যাবে এবং দুর্নীতি বেড়েই চলবে।
এম হাফিজউদ্দীন খান: চেয়ারম্যান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.