শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধির বিপক্ষে বিজিএমইএ by আবুল কাশেম

শ্রম আইন-২০০৬ সংশোধন করে মহিলা শ্রমিকদের প্রসূতিকালীন ছুটি বাড়াতে চায় সরকার। বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে প্রসূতিকল্যাণ সুবিধাও। কমপক্ষে এক হাজার শ্রমিক রয়েছে এমন সব কারখানায় শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল রাখার বাধ্যবাধকতাও আরোপ করতে চাইছে সরকার।


সব ধরনের শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রেই এই সংশোধিত শ্রম আইন প্রযোজ্য হবে। তবে বেসরকারি খাতে শিল্প মালিকদের সংগঠন এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন ও বিজিএমইএ এই সংশোধনীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিজিএমইএ সরকারকে বলেছে, সংশোধিত আইন বাস্তবায়ন করা হলে 'শ্রমিকদের ঘরে ঘরে গর্ভবতী মহিলা দেখা যাবে। জন্মহার বৃদ্ধি পাবে।' এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন গত সপ্তাহে এবং বিজিএমইএ তারও আগে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে তাদের আপত্তির কথা জানায়।
কালের কণ্ঠকে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএর সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি ২৪ সপ্তাহ করা হলে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে যাবে। আর কারখানায় হাসপাতাল নির্মাণ সম্পর্কে এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেছেন, 'আমরা কারখানা করেছি উৎপাদনের জন্য, চিকিৎসার জন্য নয়। সচিবালয়ে অনেক শ্রমিক-কর্মচারী আছেন। সেখানে তো কোনো হাসপাতাল করেনি সরকার।' তবে শ্রমমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, 'জুজুর ভয় দেখালে হবে না। সরকার মালিকের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়েই শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করবে।'
'উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে' : শ্রম আইন ২০০৬-এর সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক মহিলা শ্রমিক তাঁর মালিকের কাছ থেকে সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ থেকে আগের ১২ সপ্তাহ ও প্রসবের পরের ১২ সপ্তাহ মিলিয়ে মোট ২৪ সপ্তাহের জন্য ছুটি পাওয়ার অধিকারী হবে। অন্তত ছয় মাস ধরে চাকরি করে আসছেন- এমন মহিলা শ্রমিককে এই প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা দিতে মালিকপক্ষ বাধ্য থাকবে। তবে এ সুবিধা পেতে হলে কোনো মালিকের অধীনে সন্তান প্রসবের আগে অন্তত ছয় মাস চাকরি করতে হবে।
বিজিএমইএ আগের মতো প্রসূতিকালীন ছুটি আট সপ্তাহ করে মোট ১৬ সপ্তাহ বহাল রাখার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। তারা আরো বলেছে, ছয় মাস নয়, কমপক্ষে ১২ মাস ধরে চাকরি করেন এমন শ্রমিকই এ সুবিধা পাবেন।
বিজিএমইএ আরো বলেছে, 'আশির দশক থেকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পোশাক শিল্প মূল্যবান অবদান রেখে আসছে। এ শিল্পের কাজের ধারাবাহিকতার কারণে অনেক নারী শ্রমিক সহজে সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা চিন্তা করতেন না। বিজিএমইএ মনে করে, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ১৬ (৮+৮) সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে ২৪ সপ্তাহ করা হলে জন্ম নিয়ন্ত্রণ না হয়ে জন্মহার বৃদ্ধিকে উৎসাহ দেওয়া হবে। শ্রমিকের বদলে ঘরে ঘরে গর্ভবতী মহিলা দেখা যাবে। জন্মহার বাড়বে। উৎপাদন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।'
২০০৬ সালের শ্রম আইনে প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা পরিশোধের পদ্ধতিটি নিয়ে অস্পষ্টতা থাকায় প্রায়ই শ্রমিকদের এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। সংশোধিত আইনের খসড়ায় পদ্ধতিগুলো স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো অন্তঃসত্ত্বা মহিলা এ আইনের অধীন প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হলে তিনি যেকোনো দিন মালিককে লিখিতভাবে বা মৌখিকভাবে নোটিশ দেবেন যে, নোটিশের ১২ সপ্তাহের মধ্যে তাঁর সন্তান প্রসবের সম্ভাবনা আছে। এই নোটিশে ওই শ্রমিক মারা গেলে তাঁর সুবিধা যিনি গ্রহণ করবেন, তাঁর নামও উল্লেখ থাকবে। এতে শ্রমিক সন্তান প্রসবের পরেও ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত কাজে অনুপস্থিত থাকার অনুমতি পাবেন। শ্রমিকের নোটিশ পাওয়ার পর মালিক তিন দিনের মধ্যে শ্রমিককে ১২ সপ্তাহের প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা দেবেন। তারপর সন্তান প্রসবের প্রমাণ পেশ করার তারিখ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে পরের ১২ সপ্তাহের কল্যাণ সুবিধা পরিশোধ করবেন। তবে বিজিএমইএ প্রস্তাব করে বলেছে, তারা ১২ সপ্তাহ করে ২৪ সপ্তাহের প্রসবকালীন সুবিধা দেবে না। বরং আট সপ্তাহ করে ১৬ সপ্তাহের ছুটি সুবিধা দেবে।
'কারখানা চিকিৎসার জন্য না' : শ্রমিকদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ২০০৬ সালের ৮৯ ধারায় দুটি নতুন উপধারা যোগ করার প্রস্তাব করেছে সরকার। এতে বলা হয়েছে, এক হাজার বা তার চেয়ে বেশি শ্রমিক থাকলে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিক হাসপাতালের ব্যবস্থা রাখবেন। পেশাগত রোগে আক্রান্ত শ্রমিক ও কর্মচারীকে মালিকপক্ষ নিজ খরচে ও দায়িত্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করাবে। বিজিএমইএ এর বিরোধিতা করেছে। তাদের কথা হচ্ছে, কোনো শ্রমিক অব্যাহতভাবে কোনো কারখানায় পাঁচ বছর চাকরির পর পেশাগত রোগে আক্রান্ত হলে তবেই তাঁর চিকিৎসার দায়ভার তারা নেবে। বিজিএমইএ যুক্তি দিয়ে বলেছে, 'পোশাক শিল্প শ্রমঘন। প্রায় প্রতিটি কারখানায় দুই হাজার থেকে চার হাজার শ্রমিক কর্মরত। প্রস্তাবিত সংশোধনী গ্রহণ করা হলে প্রতিটি কারখানাতেই হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। এতে শিল্পঘন এলাকায় কারখানার বদলে শুধু হাসপাতাল দেখা যাবে, যা কোনোক্রমেই কাম্য নয়।' বিজিএমইএ আরো বলেছে, কোনো শ্রমিক নিয়োগের আগে পেশাগত ব্যাধিতে আক্রান্ত কি না, তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। ফলে ভিন্ন কোনো অবস্থান থেকে অসুস্থ হয়ে কারখানায় চাকরি নিলে এর দায় মালিকের ওপর বর্তানো যৌক্তিক নয়।
শ্রম আইন ২০০৬-এর ১৬১ ধারায় চুক্তির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে বলা আছে। সংশোধিত আইনের খসড়ায় এতে যোগ করা হয়েছে, 'শ্রমিক যদি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাইরে কাজে বা যাতায়াতকালে দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত হয়, তাহলে এ আইনের বিধানমতে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী হবে।' তবে বিজিএমইএ বলেছে, 'মালিকের কাজ হচ্ছে বা সচরাচর হয় অথবা মালিকের নিয়ন্ত্রণে বা ব্যবস্থাপনায় আছে এরূপ স্থান ব্যতীত অন্য কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সে ক্ষেত্রে এ ধারা প্রযোজ্য হবে না।'
বিজিএমইএ সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মাতৃত্বকালীন ছুটি ও প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেন, পোশাক কারখানার শ্রমিকরা এত দিন সহজেই সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা ভাবত না। এর মধ্য দিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখে চলেছে। এখন সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় ২৪ সপ্তাহ ছুটি পেলে সবাই সন্তান নিতে আগ্রহী হবে। এতে জনসংখ্যাও বাড়বে।
শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নির্মাণ প্রসঙ্গে এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো. ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার খসড়া আইনে অনেক অবাস্তব কথা বলেছে। এক হাজার শ্রমিক থাকলেই সেখানে হাসপাতাল রাখার কথা বলা হয়েছে। আমরা কারখানা করেছি উৎপাদনের জন্য, চিকিৎসার জন্য তো করিনি। কিছুদিন পরে হয়তো সরকার বলবে, শ্রমিকদের মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়ার জন্য একটি ফোন চার্জার রুম, শ্রমিকদের খাওয়ার জন্য একটি রেস্টুরেন্টও রাখতে হবে। তাহলে তো সব কারখানাই একটি করে শহর হয়ে যাবে। তাই হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।'
শ্রমমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, 'বিজিএমইএসহ মালিকরা শুধু আপত্তির কারণে আপত্তি করলে সরকার তা বিবেচনা করবে না। আমরা এমন কিছু করব না, যাতে মালিকদের ক্ষতি হয়। তবে শ্রমিকদের স্বার্থও আমরা রক্ষা করব।' মন্ত্রী আরো বলেন, মালিক-শ্রমিক-সরকার এই ত্রিপক্ষীয় কমিটির বৈঠকে আইন চূড়ান্ত করা হবে। এতে মালিক-শ্রমিক উভয়ের স্বার্থই সরকার সমানভাবে বিবেচনা করবে।

No comments

Powered by Blogger.