অরক্ষিত সংসদ এলাকা-স্পিকার বললেন, আইন মানেন না এমপিরাই by নিখিল ভদ্র

সংরক্ষিত সংসদ ভবন এলাকা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। প্রতারকচক্র ও হত্যা মামলার আসামি গ্রেপ্তার এবং সর্বশেষ পুরনো এমপি হোস্টেল থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর স্পর্শকাতর এই এলাকার নিরাপত্তা প্রশ্নের সম্মুখীন। অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ জনবল এবং আইনপ্রণেতা হয়েও এমপিদের আইন না মানার প্রবণতা এ পরিস্থিতির কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিষয়টি নিয়ে স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ নিজেও ক্ষোভ এবং হতাশা প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে স্পিকার বলেন, 'বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও অনেক এমপিই নির্দেশনা মানেন না। আবার সংসদ সচিবালয়ে জনবলের অভাব রয়েছে। যেসব পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে, তারাও যথেষ্ট দক্ষ নয়। এ নিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীকেও বলেছি, লস্কর-ই-তৈয়বার মতো কোনো জঙ্গি সংগঠন আক্রমণ করলে এই ফোর্স দিয়ে কিছুই করা যাবে না। সংসদ ভবনে সোয়াতের মতো এলিট ফোর্স নিযুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।'
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বরাবরই সংসদ ভবন এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংসদ ভবন থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তিন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমান সরকারের আমলেও একের পর এক ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ গত ২২ এপ্রিল সংরক্ষিত সংসদ ভবন এলাকার পুরনো এমপি হোস্টেল থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এমপি হোস্টেলের ৭ নম্বর গেটের ৬ নম্বর ব্লকে বাথরুমের সামনে ওই অর্ধগলিত মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর আগে সংরক্ষিত এ এলাকায় চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওনের গাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম।
২০১০ সালের ১ নভেম্বর দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য শাহ জিকরুল আহমেদের এমপি হোস্টেলের অফিস কক্ষ থেকে আটজনকে আটক করেন নিরাপত্তাকর্মীরা। পরে তাদের মধ্য থেকে প্রতারণার অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে শেরে বাংলানগর থানার পুলিশ। অবশ্য মূল প্রতারক মোল্লা সাইদুর রহমান আগেই পালিয়ে যায়। ওই পাঁচজনের মধ্যে একজন আবার ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজির আহমেদের সহকারী। আটককৃতদের কাছ থেকে জাতীয় সংসদের ভুয়া পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়। এই প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এরপর ওই বছরের ৮ নভেম্বর ন্যাম ফ্ল্যাটের সামনে থেকে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নুর বাবু হত্যা মামলার তিন আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো বাদশা (২৫), আশরাফুল ইসলাম মিঠু (২৮) ও লুৎফর রহমান (৩০)। বাবু নিহত হওয়ার পরপরই পালিয়ে ঢাকায় এসে তারা ন্যাম ফ্ল্যাটে অবস্থান করছিল। নাটোর থেকে নির্বাচিত সরকারি দলের এক সংসদ সদস্য তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে সে সময় আসামিরা পুলিশকে জানায়।
সংসদ কমিটির তদন্তে পাওয়া গেছে, এমপি হোস্টেল ও ন্যাম ফ্ল্যাট এমপিদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেখানে বেশির ভাগ এমপিই থাকেন না। থাকেন তাঁদের কর্মচারী, ড্রাইভার, দলীয় কর্মী ও আত্মীয়স্বজন। এমনকি বিভিন্ন মামলার আসামিরা সেখানে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে তারা নানা অসামাজিক কাজ করে থাকে। এ বিষয়ে সংসদ অধিবেশনেও অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। পরে এমপি হোস্টেল দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংসদ কমিটি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে অর্ধশতাধিক এমপিকে সতর্ক করে চিঠি দেয়। অনেককে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়। আর এমপি হোস্টেল থেকে প্রতারকচক্র গ্রেপ্তার হওয়ার পর স্পিকার এমপিদের নামে বরাদ্দকৃত রুমের চাবি অন্যের হাতে হন্তান্তর না করার নির্দেশ দেন। এর আগে নবম সংসদ গঠিত হওয়ার পর সংসদ ভবন এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডেপুটি স্পিকারের নেতৃত্বে বিশেষ কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ করে। যদিও সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেই।
সূত্র মতে, বিশেষ কমিটির সুপারিশের মধ্যে ছিল, সংসদ ভবনের চারপাশে (দুই হাজার একর) সীমানাপ্রাচীর তিন ফুট থেকে বাড়িয়ে আট-দশ ফুট করা, ভবনের প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টর বসানো, সিসিটিভি ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর করা, গাড়িগুলোকে স্ক্যানিংয়ের জন্য আন্ডার ভেহিকেল রিভার্স সিস্টেম চালু, সংসদের সব কর্মচারীর পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি, এন্ট্রি পয়েন্ট কমানো ইত্যাদি। এ ছাড়া পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অধীনে একটি বিশেষ ফোর্স গঠনের প্রস্তাব করা হয়।
সংসদ ভবনের নিরাপত্তার বিষয়ে স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেন, নিরাপত্তার জন্য একটি বিশেষ বাহিনী গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। এর পরও সংসদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, অর্থের কারণে অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। সংসদ ভবনের চারপাশে মাত্র তিন ফুট উচ্চতার বেড়া দেওয়া আছে। যে কেউ এ বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে। বেড়া আরো উঁচু করে সুচালো রড গেঁথে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল, বাস্তবায়ন হয়নি। সংসদে অবাধে গাড়ি প্রবেশ করে। গাড়ি চেকিংয়ের জন্য ভেহিকেল স্ক্যানার কেনার কথা থাকলেও তা কেনা যায়নি।
সম্প্রতি পুরনো এমপি হোস্টেলে এক নারীর লাশ পাওয়া প্রসঙ্গে স্পিকার বলেন, 'আমি বুঝতে পারছি না ঘটনাটি কিভাবে ঘটেছে। তদন্ত কর্মকর্তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য আমি সংসদের সংশ্লিষ্ট কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি।'
স্পিকার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'বারবার নির্দেশ দেওয়ার পরও কেন এমপিরা তা মানেন না আমি বুঝতে পারি না। আমি তো রুমে রুমে গিয়ে চেক করতে পারি না। আমি সংসদ সদস্যদের কার্যালয়ে কাজ শেষ করার পর রুম বন্ধ করে চাবি নিয়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু অনেক সংসদ সদস্য এটা মানেন না। তাঁরা রুমে-বাসভবনে ব্যক্তিগত সহকারী ও পরিচিতদের থাকতে দেন। রাতে নিরাপত্তাকর্মীরা চেকিংয়ে গেলে বাতি বন্ধ করে ওই সব লোক রুমে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। এই বহিরাগতদের কারণে নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অপকর্মের তথ্যও পাওয়া গেছে। কাউকে কাউকে রুম থেকে বের করে পুলিশেও দেওয়া হয়েছে।'
উল্লেখ্য, মূল সংসদ ভবনের পূর্ব দিকে এমপি হোস্টেলের মোট ছয়টি ব্লকে প্রায় ২৪০টি কক্ষ এমপিদের অফিস হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষ প্রবেশ করে। ফলে একের পর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন স্পিকারসহ পুরো সংসদ সচিবালয়।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংসদের নিরাপত্তার বিষয়ে এরই মধ্যে স্পিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সংসদ ভবন ও এমপি হোস্টেলের প্রবেশদ্বারগুলোতে তল্লাশি বাড়ানো এবং এমপি হোস্টেলে নিয়মিত অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন স্পিকার। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

No comments

Powered by Blogger.