ধর্ম-দেশকে ভালোবাসা ঈমানের অংশ by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

সৃষ্টির সেরা বা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে মানুষের মধ্যে যে সত্গুণাবলি থাকে তন্মধ্যে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ অন্যতম। মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ধর্মপ্রাণ মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি। মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি—এ তিনটি জিনিস মানুষের কাছে মহামূল্যবান।


বড় হয়ে জীবন-জীবিকার প্রয়োজন ও কর্তব্যের টানে বিদেশে বসবাস করলেও মানুষ জন্মভূমির কথা, মাতৃভূমির মায়া ভুলতে পারে না। এসবের প্রভাব প্রতিটি মানুষের দেহ, মন ও প্রাণে বিদ্যমান থাকে। মাতৃভূমি ও জন্মস্থানের প্রতি মানুষের এ দুর্নিবার আকর্ষণ বা ভালোবাসা, গভীর অনুভূতি ও মমত্ববোধকে বলে দেশপ্রেম। ইসলামের দৃষ্টিতে দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে হলে স্বদেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে মহানবী (সা.) জনগণের উদ্দেশে বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানুষের উচিত দেশকে ভালোবাসা। যে লোক দেশকে ভালোবাসে না, সে প্রকৃত ঈমানদার নয়।’
স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা মানব চরিত্রের একটি মহত্ গুণ। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারেরও প্রয়োজন হতে পারে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারলে মান-সম্মান, স্বাধিকার ও ঈমান-আমল রক্ষা করা যায় না। এ জন্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বদেশপ্রেমের কথা বলা হয়েছে। ইসলামে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার জোরালো দিকনির্দেশনা রয়েছে। তাই আরবি প্রবাদে বলা হয়, ‘হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ঈমান’ অর্থাত্ ‘দেশকে ভালোবাসা ঈমানের অংশ’।
ইসলামে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনাদর্শে ও স্বভাব-চরিত্রে দেশপ্রেমের অনন্য নজির উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। তিনি স্বদেশকে খুব ভালোবাসতেন, মক্কার কাফেরদের নির্মম নির্যাতনে যখন স্ব্বজাতি কর্তৃক বিতাড়িত অবস্থায় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করছিলেন, তখন তিনি বারবার মক্কার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর কাতরকণ্ঠে আফসোস করে বলেছিলেন, ‘হে আমার স্বদেশ! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে কতই না ভালোবাসি। আমার আপন গোত্রের লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ সাহাবায়ে কিরামও স্বদেশকে খুব ভালোবাসতেন। হিজরতের পর মদিনায় হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় তাঁদের মনে-প্রাণে স্বদেশ মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠেছিল। তাঁরা জন্মভূমি মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। এমতাবস্থায় নবী করিম (সা.) সাহাবিদের মনের এ দুরবস্থা দেখে প্রাণভরে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি তার চেয়েও বেশি মদিনার ভালোবাসা আমাদের অন্তরে দান করুন।’ (বুখারি)
দেশ ও জাতির জন্য আত্মনিবেদিত মানুষেরা সমাজের চোখে যেমন সম্মানিত, তেমনি আল্লাহর কাছেও অত্যন্ত গৌরবময় মর্যাদার অধিকারী। নবুওয়াত লাভের পর সুদীর্ঘ ১৩ বছর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা স্বদেশ মক্কায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছেন এবং নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁরা দেশ ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিজয়ীর বেশে মহানবী (সা.) যখন জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন মুসলমানদের ওপর যে ভীষণ অন্যায় ও অত্যাচার করা হয়েছিল, তা বিস্মৃত হলেন এবং দেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার আদর্শ স্থাপন করেন।
দেশপ্রেমের ফলে মানুষের মন উদার ও মহত্প্রাণ হয়। তার ভেতর অপরের জন্য কল্যাণবোধ জন্মলাভ করে। তাই দেশের স্বার্থবিরোধীদের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালানো উচিত। দেশের সীমান্তরক্ষী প্রহরীদের সম্পর্কে নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘এক দিন ও এক রাতের সীমান্ত পাহারা ক্রমাগত এক মাসের সিয়াম সাধনা ও সারা রাত নফল ইবাদতে কাটানো অপেক্ষা উত্তম।’ (মুসলিম) দেশপ্রেম জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘দুটো চোখ জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না, একটি চোখ আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে আর একটি চোখ যা সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে।’ (তিরমিজি) হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যারা স্বদেশ রক্ষার উদ্দেশে সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে, তাদের জন্য জান্নাত।’
দেশপ্রেম মানুষকে মাতৃত্ববোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহজ ও সরল আচরণ শেখায়। নিজ দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি, সুখী ও মঙ্গলের জন্য ভাবতে অনুপ্রাণিত করে। দেশের মানুষের বিভিন্ন দল-মত, সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পরস্পরের প্রতি বিরোধ, সংঘর্ষ ও প্রতিহিংসার পরিবর্তে একে অন্যের সহযোগিতা, সহানুভূতি ও পৃষ্ঠপোষকতার ভাবধারা গড়ে তোলার জন্য পরমতসহিষ্ণুতার শিষ্টাচার গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। দেশাত্মবোধ ও স্বদেশের প্রতি মমতা অনেক অন্যায় ও অপরাধপ্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে। তাই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে হলে অবশ্যই দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। স্বদেশের প্রতি অনুগত থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশকে ভালোবাসা সবার ঈমানি দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য। সর্বোপরি দেশের জনগণের যার যার ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা, ইসলামি বিধি-নিষেধের যথার্থ অনুশীলন আমাদের প্রকৃত ঈমানদার মানুষে পরিণত করতে পারে এবং সমাজ জীবনে বয়ে আনতে পারে শান্তি-সুখের সুশীতল সমীরণ। বিত্তশালী ধর্মপ্রাণ লোকেরা চেষ্টা করলে মানুষের জন্য, দেশের জন্য অনেক কল্যাণকর কিছু করতে পারেন। মনের বিশুদ্ধতা ও প্রসারতায় যাঁরা দেশপ্রেম, সত্কর্ম, সত্যনিষ্ঠা ও সুশাসনের মাধ্যমে পৃথিবীতে অবদান রাখবেন, তাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিয়েছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস করে ও সত্কর্ম করে, তাদের অভ্যর্থনার জন্য আছে জান্নাতুল ফেরদৌস, যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে; তা হতে স্থানান্তর কামনা করবে না।’ (সূরা আল-কাহ্ফ, আয়াত: ১০৭-১০৮)
ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ মানুষকে স্বদেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষণে দেশপ্রেমিক নিজের জান-মাল উত্সর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। স্বদেশকে হেফাজত না করতে পারলে ধর্মকে হেফাজত করা যায় না, দেশের মানুষকে রক্ষা করা যায় না, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা যায় না। দেশপ্রেম ধর্মভীরু মানুষকে স্বদেশের উন্নতি সাধনে সজাগ রাখে, দেশের জাতীয় সম্পদ অপচয় রোধে উদ্বুদ্ধ করে। আর দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবোধ ব্যতীত কোনো দেশের স্বাধীনতা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। তাই আল্লাহ তাআলা ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলার মাটি থেকে জঙ্গিবাদী বোমাবাজ, চরমপন্থী, সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি, চাঁদাবাজ, ঘুষখোর, অবৈধ মজুদদার, ভেজাল ব্যবসায়ী, দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী ও দেশের স্বার্থবিরোধী দুর্নীতিবাজদের মূলোত্পাটন করে একটি সুখী-সমৃদ্ধিশালী শোষণমুক্ত স্বাবলম্বী সোনার বাংলাদেশ গঠনের তাওফিক দান করুন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.