সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-হিলারি এলেন-গেলেন এবং যা শিখলাম by মাসুদা ভাট্টি

একটি পশ্চিমা প্রভাবের ও দীর্ঘস্থায়ী অরাজনৈতিক সরকারের হাতে বাংলাদেশের শাসনভার দেওয়ার কথা অনেক দিন থেকেই শোনা যায়। অনেকেই মনে করে, দেশের কিছু অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে যেগুলো কোনো রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেই সমাধা করা সম্ভব নয়।


এমনকি কেউ কেউ একটু আগ বাড়িয়ে এটিও ভাবেন যে, প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে বাংলাদেশকে একটি অনির্বাচিত সরকারের হাতে দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি

হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসবেন কি আসবেন না তা নিয়ে যত উদ্বেগ ছিল, তার সফর শেষে বাংলাদেশ সফর-পরবর্তী বিশ্লেষণও বেশ উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে সর্বত্র। বিশেষ করে সরকারের সঙ্গে হিলারি ক্লিনটনের ব্যক্তিগত বন্ধু ড. ইউনূসের মনোমালিন্য যখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করা হয় অত্যন্ত সুকৌশলে এবং সে কারণে ক্ষমতাসীন সরকারকে পশ্চিমের হাতে মার খাওয়াতে গিয়ে গোটা বাংলাদেশকেই বিপদগ্রস্ত করার যে চক্রান্ত আমরা দেখছি বিগত বছরখানেক ধরে তা এখন কোনদিকে মোড় নেয় সেটি নিয়ে সবাই কম-বেশি উদ্বিগ্ন। হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে এসে যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ তিনি কী কী করেছেন, কার কার সঙ্গে কথা বলেছেন সেগুলো বিশ্লেষণে আমরা কিছু ভালো এবং মন্দ ইঙ্গিত পাই।
হিলারি ক্লিনটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একক শক্তিধর রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দেশটির প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরই তার অবস্থান, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। সেদিক দিয়ে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের কথা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে উচ্চারিত হলেও মাঝে ড. ইউনূস ইস্যুতে অনেকেই মনে করেছিলেন যে, এ সরকারের আমলে তিনি হয়তো আর এ দেশে আসবেন না। বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যত ভালোই হোক না কেন, ড. ইউনূস যেহেতু তার ব্যক্তিগত বন্ধু সেহেতু তিনি একে বেশ গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছেন এবং বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তার 'গুড বুক'-এ নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, ব্যক্তিগত সম্পর্ক দিয়ে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণ আদৌ সম্ভব কি-না? যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ভুগছে নানা টানাপড়েনে, দেশে দেশে মার্কিন বিদ্বেষ এমন এক পর্যায়ে এসে পেঁৗছেছে, যা থেকে মুক্ত হওয়া খুব সহজে সম্ভব নয় বলে মার্কিন রাষ্ট্র-বিশেষজ্ঞরাই বলছেন। এ রকম এক সময়ে হিলারি ক্লিনটন ড. ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের টানপড়েনের অজুহাতে অযৌক্তিকভাবে বন্ধুর পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশ সফর স্থগিত করবেন কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সে মেঘ কেটে গেছে এবং তিনি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন নির্বিঘ্নে_ এটাই এ সফরের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। আরেকটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, বাংলাদেশ যে গুরুত্বহীন একটি দেশ নয়, আন্তর্জাতিকভাবে এ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির যে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে তাও হিলারি ক্লিনটন ও প্রণব মুখার্জির সফরের ভেতর দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। এখন এ গুরুত্বকে আমরা নিজেরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারব সেটাই দেখার বিষয়।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, যে সময়ে হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে এলেন তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা শান্ত নয়। বিবদমান দুটি পক্ষ আগামী নির্বাচন ইস্যুতে ইতিমধ্যেই মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আপৎকালীন সমাধান হিসেবে নব্বইয়ের দশকে জনগণের দাবি ছিল আজ সেটাই হয়েছে কালসাপ। বিশেষ করে সেনা সমর্থিত ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে এখতিয়ার-বহির্ভূত কাজ-কর্ম শুরু করে তখন দেশ-বিদেশের সর্বত্রই এ সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। আলোচ্য এ সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া আর কিছুই জাতিকে দিতে পারেনি, এমন আলোচনা আমরা শুনেছি। কিন্তু সে নির্বাচনও বর্তমান বিরোধী দল সুষ্ঠু হয়েছে বলে মেনে নেয়নি। এর আগের তত্ত্বাবধায়ক আমলেও একই ঘটনা ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে কেন আবারও তত্ত্বাবধায়কের দাবি তোলা হচ্ছে সে প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক।
বিরোধীদলীয় নেতা হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে আলাপচারিতায় এ প্রশ্ন যখন তোলেন তখন সেটা অস্বাভাবিক লাগে না। এ দাবি অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এলেও গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু এ দাবি আমরা শুনতে পেলাম এমন দুই মানুষের মুখ থেকে, রাজনীতির সঙ্গে যাদের বিন্দুমাত্র সংস্রব (বাহ্যত) নেই। তাদের একজন নোবেল লরিয়েট এবং অন্যজন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সর্বোচ্চ খেতাব নাইটহুডপ্রাপ্ত। হয়তো তারা দু'জনই রাজপথে এ মৃত্যু, অগ্নুৎসব এবং হরতালের মতো অস্থিতিশীল পরিবেশে জনগণের অসুবিধার কথা ভেবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু বিগত কয়েকটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা ও নির্বাচন-পরবর্তী পরাজিত রাজনৈতিক দলের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ইতিহাস জেনেও কোন ভরসায় তারা মনে করছেন যে, আবার একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে সব পক্ষ বিনা বাক্যে মেনে নেবে এবং দেশে একটি কার্যকর সংসদীয় গণতন্ত্র চালু থাকবে?
এ প্রশ্নই আসলে নেতিবাচক ও ভয় ধরানো চিন্তার উদ্রেক করে। সেটা এ কারণে যে, একটি পশ্চিমা প্রভাবের ও দীর্ঘস্থায়ী অরাজনৈতিক সরকারের হাতে বাংলাদেশের শাসনভার দেওয়ার কথা অনেক দিন থেকেই শোনা যায়। অনেকেই মনে করে, দেশের কিছু অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে যেগুলো কোনো রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেই সমাধা করা সম্ভব নয়। এমনকি কেউ কেউ একটু আগ বাড়িয়ে এটিও ভাবেন যে, প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে বাংলাদেশকে একটি অনির্বাচিত সরকারের হাতে দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। বিদেশের বিভিন্ন প্লাটফর্মে বিভিন্ন বক্তৃতায় দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্ষুদ্রঋণ বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের কেউ কেউ এরকমটাই বলে থাকেন। সেদিক দিয়ে বিচার করলে হিলারি ক্লিনটনের কাছে কোন রকম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ড. ইউনূস ও স্যার আবেদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানালেন তা স্পষ্ট হলো না। আমরা জানি, সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী একটি দল উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দিয়েছে। এখন আবার সে পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে হলে আদালত অবমাননার ঘটনা ঘটবে এবং আবারও সংসদের মাধ্যমে তা বৈধ করাতে হবে। ড. ইউনূস ও স্যার আবেদ এরকম একটি বিষয়কে কেন মার্কিন মুলুকের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতে গেলেন সেটাই আসলে যুক্তিগ্রাহ্য নয়। রাজনৈতিক দলগুলো না হয় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কাজ করে এবং সে জন্য যে কোনো বিদেশির কাছে দেশীয় ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে নালিশ জানাতে দ্বিধাবোধ করে না, আমরা তো এ জন্য তাদের সমালোচনা হামেশাই করে থাকি। কিন্তু দেশের দু'জন সর্বোচ্চ মননের মানুষ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যারা বাংলাদেশের মুখপাত্র হিসেবে বিবেচ্য, তারাও যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতো বিদেশিদের সামনে নিন্দার ঝাঁপি খুলে বসেন তাহলে আমাদের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা আর থাকে কি?
পাদটীকা : সেদিন এক বন্ধু হাসতে হাসতে বললেন, রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের তাওয়ায় ভাজে, আমরা রুটির মতো পুড়ি, তারপরও পোড়া অংশ বাদ দিয়ে আমরা বেশ এগিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু অরাজনৈতিক সরকার যে আমাদের চুলায় ফেলেই ছাই করে দেবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? বন্ধুর এ হাস্যোক্তি সত্যিই ভেবে দেখার মতো।

gvmy`v fvwÆ : mvsevw`K
masuda.bhatti@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.