কোর্ট ম্যারেজের ভিত্তি কী? by তানজিম আল ইসলাম

আইন অধিকার ফেসবুক পেজে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফেসবুক বন্ধুর পাঠানো একটি সমস্যা তুলে ধরে লেখাটি শুরু করছি। ‘আমার এক মামাতো বোন আমাদের দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের সঙ্গে এক বছর ধরে মোবাইল ফোনে কথা বলত। একসময় তারা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। ছেলেটি অশিক্ষিত ও বেকার।


অন্যদিকে, আমার মামাতো বোন এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। কয়েক মাস আগে ছেলেটির বড় বোন আমার বড় মামাতো বোনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমার বোন প্রস্তাব ফিরিয়ে না দিয়ে পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। এদিকে কয়েক দিন আগে আমরা জানতে পারি, ছেলেটি আমার বোনটিকে কোর্ট ম্যারেজ করেছে এবং আমাদের নামে থানায় জিডি করেছে। মামাতো বোন থেকে জানতে পারি, কোর্ট ম্যারেজ করার তার কোনো ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছিল না। ছেলেটি কয়েকজন বন্ধুসহ এসে তাকে কলেজের সামনে থেকে নিয়ে যায়। ছেলেটি তাকে বলেছে, সে যদি এখন কোর্ট ম্যারেজ না করে, তবে ছেলেটি গাড়ির নিচে পড়ে আত্মহত্যা করবে। আর এ জন্য আমাদের জেলে যেতে হবে। ছেলেটির বড় বোন তখন ফোন করে তাকে একই রকমের ভয় দেখিয়ে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল। বিয়েতে মেয়ের পক্ষের সাক্ষী হিসেবে আমার মামাতো ভাইয়ের নাম ও স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে বলে আমরা জানতে পারি। কিন্তু সে তখন সেখানে উপস্থিত ছিল না। অন্য একটি ছেলেকে মেয়ের ভাই পরিচয় দিয়ে এটা করা হয়েছে। আমাদের পরিবারের কেউ এ বিয়ে মেনে নিচ্ছে না। আমরা এই বিয়ে ভেঙে দিতে চাইছি। অর্থাৎ ডিভোর্স নিয়ে নিতে চাইছি। হিন্দু ধর্ম অনুসারে কোর্ট ম্যারেজের ভিত্তি কী? ডিভোর্স নেওয়া যায় কি? গেলে কীভাবে ডিভোর্স নিতে হয়? ডিভোর্স নিয়ে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে কোনো আইনি সমস্যা হবে কি? এ ছাড়া ছেলে ও ছেলের বড় বোনের বিরুদ্ধে আমরা কী ধরনের আইনি ব্যবস্থা নিতে পারি?’

ঘটনা-১
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া রাফি ও মমের (ছদ্মনাম) মধ্যে দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক। মমর বাবা অন্যত্র বিয়ে ঠিক করলে মম রাফিকে জানায় বিয়ের কথা। তখন তারা দুজন ঠিক করে, গোপনে বিয়ে করবে। তাদের এক বন্ধুর সহায়তায় কোর্ট ম্যারেজ করবে। পরিচিত এক আইনজীবীর চেম্বারে গিয়ে তারা কোর্ট ম্যারেজের প্রস্তুতি নেয়। আইনজীবী বিয়ের হলফনামা লিখে দেন এবং এটি নোটারি পাবলিক করা হয়।

ঘটনা-২
আসলাম ও শাহানা (ছদ্মনাম) দুই বছর আগে কোর্ট ম্যারেজ করে। তাদের মধ্যে কোনো বিয়ের কাবিননামা সম্পন্ন হয়নি। দুই বছরের মাথায় তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ তৈরি হয়। তারা দুজনই সিদ্ধান্ত নেয় তালাক নেবে। কিন্তু তারা এখন তালাক নেবে কীভাবে? তাদের মধ্যে তো কোনো কাবিনই হয়নি।
ওপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে অহরহ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই দেখা যায়, প্রেমিকযুগল মা-বাবার অমতে কোর্ট ম্যারেজ করতে চায়। এ জন্য তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে। কিন্তু কোর্ট ম্যারেজ বলতে আসলে কী বোঝায়? আইনে এর ভিত্তি কতটা, এ সম্পর্কে অধিকাংশ লোকই অজ্ঞ। কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে না জানার কারণে পরবর্তী সময়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। আইনে কোর্ট ম্যারেজ বলে কোনো শব্দ নেই এবং এর কোনো ভিত্তি নেই। এটি একটি প্রচলিত শব্দ। সাধারণত নর-নারীর মধ্যে বিয়েসংক্রান্ত ঘোষণা হলফনামার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে এবং এ হলফনামাটি ৫০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখে নোটারি পাবলিক কিংবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এ হলফনামার মাধ্যমে আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে, এটি বলা যাবে না। এটি বিয়ের ঘোষণামাত্র। অর্থাৎ এ হলফনামার মাধ্যমে বর-কনে নিজেদের মধ্যে আইন অনুযায়ী বিয়ে হয়েছে, এ মর্মে ঘোষণা দেয় মাত্র। একেই প্রচলিত ভাষায় কোর্ট ম্যারেজ বলা হয়।
বিয়ের হলফনামা সম্পাদন করা বাধ্যতামূলক নয়। এটি ভবিষ্যতে কোনো ঝুট-ঝামেলা থেকে পরিত্রাণে সহায়তা করতে পারে। তবে বিয়ের হলফনামা সম্পাদনের আগে নিজ নিজ পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পাদন করতে হবে।

মুসলিম আইনে কী বলা আছে
মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে কাজির মাধ্যমে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে কাবিননামা সম্পন্ন করতে হবে। মুসলিম বিয়ে ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন অনুযায়ী, প্রতিটি বিয়ে অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হবে। কার সঙ্গে কার, কত তারিখে, কোথায়, কত দেনমোহর ধার্য, কী কী শর্তে বিয়ে সম্পন্ন হলো, এর একটা হিসাব সরকারি নথিতে লিখে রাখাই হলো রেজিস্ট্রেশন। মুসলিম বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। বর্তমান আইন অনুযায়ী বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার দায়িত্ব মূলত বরের ওপর বর্তায়। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা আবশ্যক। অন্যথায় নিকাহ রেজিস্ট্রার ও পাত্রের দুই বছর পর্যন্ত বিনা শ্রম কারাদণ্ড অথবা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় ধরনের সাজার বিধান রাখা হয়েছে। যে ক্ষেত্রে কাজি বিয়ে পড়িয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে কাজি তাৎক্ষণিকভাবে বিয়ে রেজিস্ট্রি করবেন। কাজি বিয়ে না পড়িয়ে অন্য কেউ বিয়ে পড়ালে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বর ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট কাজিকে বিয়ের ৩০ দিনের মধ্যে বিয়ের সম্পর্কে জানাবেন। বর কাজিকে বিয়ে সম্পর্কে জানানোর পর কাজি তাৎক্ষণিকভাবে বিয়ে রেজিস্ট্রি করবেন। মনে রাখতে হবে, মুসলিম বিয়েতে কাবিননামা হলো বিয়ের চুক্তিপত্র। রেজিস্ট্রি করা নিকাহনামা বা কাবিননামা ছাড়া বিয়ে প্রমাণ করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিয়ে রেজিস্ট্রি করা থাকলে তালাকের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা সহজ হয়। তালাক হলে দেনমোহর ও ভরণপোষণ আদায়ের জন্য রেজিস্ট্রি করা কাবিননামার প্রয়োজন হয়। সন্তানের বৈধ পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য কাবিননামার প্রয়োজন হয় এবং স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যু হলে উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি আদায়ের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রি করা কাবিননামার প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে কাবিননামা ছাড়া শুধু বিয়ের হলফনামা সম্পন্ন করা হলে বৈবাহিক অধিকার আদায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

হিন্দু আইনে কী বলা আছে
হিন্দু বিয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই হিন্দু আইনের প্রথা মেনেই বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। কেননা, হিন্দু বিয়েতে নিবন্ধনের কোনো বিধান নেই। হিন্দু বিয়েতেও নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে প্রাপ্ত বয়সী ছেলেমেয়ে হলফনামার মাধ্যমে বিয়ের ঘোষণা দিয়ে থাকে মাত্র, যা পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বিয়ের হলফনামা একটি দালিলিক প্রমাণপত্র হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। প্রচলিত হিন্দু প্রথা না মেনে হলফনামা করা হলে এতে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল বলা যাবে না।

পরিশিষ্ট
ওপরের ফেসবুক বন্ধুর পাঠানো চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, হলফনামার মাধ্যমে হিন্দু বিয়ে হয়েছে বলা যাবে না। আর দলিলে যদি মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়, তা অপরাধ। হিন্দু আইনে বিয়ে নিবন্ধন ও তালাকের কোনো বিধান নেই। আপনারা চাইলে বিয়ের হলফনামাটি আদালতের মাধ্যমে বাতিল চাইতে পারেন। আর জোর করে এবং মিথ্যা হলফনামা সম্পন্ন করতে বাধ্য করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালতে আশ্রয় নেওয়া যায়। অন্য একটি হলফনামার মাধ্যমে পৃথক থাকার ঘোষণাও দিতে পারেন।
tanzimlaw@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.