প্রতিক্রিয়া-উপাচার্যকে না সরালে সমস্যার সমাধান নয় by রায়হান রাইন

৮ মে ২০১২ তারিখের প্রথম আলোয় ‘উপাচার্যকে সরালেই সব সমস্যার সমাধান হবে না’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছেন অধ্যাপক আবদুল মান্নান। অন্যদিকে, ২৮ এপ্রিল ২০১২ তারিখের প্রথম আলোতেও ‘শ্রেণীকক্ষ বর্জনের আন্দোলন সমর্থন করি না’ শিরোনামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত আন্দোলন সম্পর্কে নানা অপব্যাখ্যাসমেত আরেকটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।


লেখা দুটি দিয়ে প্রথম আলোর পাঠক যাতে বিভ্রান্ত না হন, সে কারণেই এই প্রতিক্রিয়ার অবতারণা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতা এক না হলেও অধ্যাপক আবদুল মান্নান সব ঘটনাকে একই পাল্লায় তুলেছেন। তাঁর মন্তব্যের সরল তাৎপর্য হলো, সত্যিই যদি কোনো উপাচার্য সন্ত্রাসী হন, এমনকি তখনো তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ঠিক হবে না, কারণ তাহলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আন্দোলন হবে। অর্থাৎ, উপাচার্য যেমনই হোক তাঁকে মেনে নেওয়াটাই সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে। নিবন্ধকারের এই মন্তব্য বিভ্রান্তিকর। ভুলে যাওয়া চলবে না যে ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে একজন উপাচার্যকে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাতে একজন উপাচার্যের পক্ষে গডফাদার হয়ে ওঠা এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। আরেকটি বাস্তব বিষয়কে গ্রাহ্য করা দরকার যে কেবল মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে কোনো আন্দোলন এত দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে না। নিবন্ধকার লিখছেন, উপাচার্যকে সরিয়ে লাভ নেই, কেননা ‘পরের জনের অবস্থাও যে আগের মতো হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?’
এই যুক্তিকে যদি আমরা মেনে নিই তাহলে কোনো কিছুকেই বদলানো যাবে না। কারণ, বদলে যাওয়া বাস্তবতা যে খারাপ হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? প্রশ্ন হলো, পরের উপাচার্য যে আগের উপাচার্যের মতোই হবেন, তার নিশ্চয়তা তিনি কোথায় পেলেন?
নিবন্ধকার লিখেছেন, যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখনই অন্য দশটি জায়গার মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ১৮৯৭ সালের আইন দিয়ে উপাচার্য মনোনয়ন দেওয়া হলেও ‘যাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করছেন, তাঁদের কেউ টুঁ শব্দটি করেননি।’ এটি ভুল তথ্য। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত উপাচার্যকে সরিয়ে অধ্যাপক জসীম উদ্দিন আহমেদকে উপাচার্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন হয় এবং তিনি নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। সেই নির্বাচনে মনোনীত উপাচার্য পরাজিত হয়ে উপাচার্যের পদ ছাড়েন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গত কয়েক বছরের শিক্ষক নিয়োগের পুরো চিত্র নিবন্ধকারের কাছে স্পষ্ট নয়। বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত নিয়োগকে যে বাস্তবতা দিয়ে তিনি বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তেমন কোনো বাস্তবতা এখানে ছিল না। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে একই বিভাগে শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে যেমন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তেমনই নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার বিবেচনা বাদ দিয়ে আত্মীয়তা, গোষ্ঠীস্বার্থ, দলীয়করণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা জ্ঞানচর্চার যে অবাধ ক্ষেত্ররূপে দেখতে চাই, সেই রূপে বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ার ক্ষেত্রে উপাচার্য নিজেই যখন বাধা হয়ে দাঁড়ান, তিনি নিজেই যখন সব সমস্যার শিকড় আগলে বসে থাকেন, তখন তাঁকে না সরিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়। একজন অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী উপাচার্য কখনোই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাম্য হতে পারে না।

২.
অধ্যাপক শফি আহমেদ তাঁর ‘শ্রেণীকক্ষ বর্জনের আন্দোলন সমর্থন করি না’ শিরোনামের নিবন্ধে অনেক ভুল তথ্যের সমাহার ঘটিয়েছেন এবং অনেক ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘একজন ছাত্রের মৃত্যুকে পুঁজি করে তাঁর পদত্যাগের দাবি গণতান্ত্রিক আচরণ বলে বিবেচিত হতে পারে না।’ এই মন্তব্যে নিবন্ধ লেখক হত্যা এবং মৃত্যুকে এক করে দেখেছেন; উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরও জুবায়েরের নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘অপঘাত’ হিসেবে দেখেছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে মর্মান্তিক বাস্তবতাটি উপাচার্য ও তাঁর প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছে, অধ্যাপক শফি আহমেদ কি তার খোঁজ জানেন? আর উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি কেবল একটি হত্যাকাণ্ডের কারণে ওঠেনি। গত তিন বছরে স্বার্থপ্রণোদিত শিক্ষক নিয়োগ, প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচার, অনিয়ম, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণ পুঞ্জীভূত হয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিকে সামনে এনেছে।
নিবন্ধকার বলেছেন, আন্দোলন করে লাভ নেই, কারণ সরকার তো আন্দোলনকারীদের ভেতর থেকে উপাচার্য বানাবে না। অধ্যাপক শফি আহমেদ হয়তো উপলব্ধি করেননি, শিক্ষক সমাজ আন্দোলন করছে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার পরিবেশের স্বার্থে, নিজেরা ভিসি হওয়ার জন্য নয়, সে কথা তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন।
অধ্যাপক শফি আহমেদ তাঁর লেখায় অনেকগুলো ভুল তথ্য দিয়েছেন। শিক্ষক সমিতিতে বাদানুবাদের পর ‘শিক্ষক সমাজ’ নামের দলটি গড়ে ওঠেনি। এটি গড়ে উঠেছিল জুবায়ের নিহত হওয়ারও আগে ১৯ ডিসেম্বর, ২০১১ সালে মেধাহীন গণনিয়োগের প্রতিবাদে। তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু ‘শিক্ষক সমাজ’ সংস্থার শিক্ষক সমিতি নিরপেক্ষ অবস্থানকে আমি বিভক্তিসূচক বলেই বিবেচনা করি।’ এই বক্তব্য স্ববিরোধী, কেননা, তিনি নিজেও শিক্ষক সমিতি নিরপেক্ষ একটি শিক্ষক সমাজের (বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ) হয়ে নিয়মিত বিবৃতি প্রদান করে থাকেন। এ ছাড়া ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ মোতাবেক শিক্ষকদের এ ধরনের সংস্থা গড়ে তোলার স্বাধীনতা রয়েছে। তাঁর বক্তব্যের জবাবে বলছি, গত চার মাসের আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার কোনো বাস গেটে আটকে দেওয়া হয়নি, কোনো অফিসেও তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়নি। কাফন মিছিল হলেও কাফন পরে প্রশাসনিক ভবনে শুয়ে পড়ার কোনো কর্মসূচি ছিল না।
বর্তমান উপাচার্যকে না সরিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা কাটবে না। উপরন্তু কেবল উপাচার্যকে সরালেই বিশ্ববিদ্যালয় রাহুমুক্ত হবে না। নতুন উপাচার্যকে অবশ্যই ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসমুক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করতে হবে। দুর্নীতি ও অনিয়মের যে পাহাড় গড়ে উঠেছে গত বছরগুলোতে, দক্ষতার সঙ্গে ভাঙতে হবে সেই অচলায়তন। শিক্ষক সমাজ নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার সেই বৃহত্তর আন্দোলনে তৎপর থাকবে।
রায়হান রাইন: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.