বিশেষ সাক্ষাত্কার-এখন তদন্তকারী সংস্থা গঠনের দিকে তাকিয়ে আছি by এম হারুন-অর-রশিদ

[যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রস্তুতি এগিয়েচলছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আহ্বায়ক লে. জেনারেল এম হারুন-অর-রশিদ (অব.)-এর দুটি সাক্ষাত্কার ছাপা হলো।  সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।]


প্রথম আলো  আইনমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করার সব প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত। আপনারা কীভাবে দেখছেন?
হারুন-অর-রশিদ  আমরা গণমাধ্যমেই জেনেছি। এর বাইরে জানি না। কয়েক মাস আগে আমরা কিছু সুপারিশ রেখেছি।
প্রথম আলো  সেসব সুপারিশের বাস্তবায়ন কী দেখছেন?
হারুন-অর-রশিদ  আমরা মূলত তদন্তকারী সংস্থা, আইনজীবী প্যানেল ও ট্রাইবুনালে কারা থাকবেন সে বিষয়ে নামের একটা সম্ভাব্য তালিকা দিয়েছিলাম। অন্যরাও দিয়েছেন। এখন আমরা অপেক্ষায় আছি। নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম দেখে মতামত দেব।
প্রথম আলো  আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারের কথা বলেছেন। কিন্তু আইনমন্ত্রী বিষয়টাকে ঠিক সেভাবে গ্রহণ করছেন না। আপনার কী মত?
হারুন-অর-রশিদ  তদন্তকারী সংস্থার কাজ শুরু করাই এখন বড় বিষয়। তারা যখনই কাজ শুরু করবে তখন তাদের কাজে অভিযোগ আসবে। এরপর তদন্ত হবে। আর তখন প্রসিকিউশন ও ট্রাইবুনালই ঠিক করবে কার বিরুদ্ধে মামলা চলবে, কার বিরুদ্ধে চলবে না। অনেকের সম্পর্কে হয়তো তেমন কোনো তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না। আমি যদি আগেই বলি যে, আমি ১০ জনের বিচার করব, তাহলে তো হবে না। তবে প্রতীকী শব্দ তিনি কী অর্থে ব্যবহার করেছেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
প্রথম আলো  এই বিচারের জন্য এ পর্যন্ত সরকার যেসব আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে তা কি যথেষ্ট কিংবা যথার্থ মনে করেন?
হারুন-অর-রশিদ  এ বিষয়ে অনেকের স্বাধীন মতামত থাকতে পারে। আলোচনা-সমালোচনা আছে। তবে আমাদের কথা হলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বাংলাদেশের সংবিধানের অংশ। এর আওতায় বিচার চলবে। এখন যে কেউ এসে বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা পরখ করে দেখতে পারে, যাতে কোনো সন্দেহ না থাকে, কোনো ক্যামেরা ট্রায়াল (গোপন বিচার) যেন না হয়। আইনগত ব্যবস্থা কিন্তু ১৯৭৩ সাল থেকেই বলবত্ রয়েছে। এত দিন এ নিয়ে কথা ওঠেনি। এখন যখন এর প্রয়োগ ঘটছে তখন অনেকে অহেতুক সমালোচনা করছে। তারা কিন্তু এটা করবেই। বিচারের প্রক্রিয়া যাতে ব্যাহত হয়, দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়ে সে চেষ্টা থাকবে।
প্রথম আলো  পুরোনো হাইকোর্ট ভবনে বিচারের যে অবকাঠামোগত প্রস্তুতি তাতে কি আপনারা সন্তুষ্ট?
হারুন-অর-রশিদ  হ্যাঁ, আমরা সন্তোষ প্রকাশ করেছি। তারপর কথা হলো, বাংলাদেশে এ ধরনের ট্রাইবুনাল তো আগে হয়নি। তাই ছোটখাটো ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে। বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলে নিশ্চয় তা শুধরে নেওয়া যাবে।
প্রথম আলো  বিচারকাজ শেষ করার বিষয়ে সরকার বলছে, তারা এই মেয়াদেই শেষ করবে। এটা কি সম্ভব?
হারুন-অর-রশিদ  না, আমরা কোনো সময়সীমা বেঁধে দিতে চাই না। বিচার শুরু হলে ট্রাইবুনাল ও প্রসিকিউশনই এটা ঠিক করে নেবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিচারপ্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ চাই। এখানে কোনো রকমের হস্তক্ষেপ চাই না।
প্রথম আলো  একটা আশঙ্কা আছে যে শাসক দল দলীয় উদ্দেশ্যে এ বিচারপ্রক্রিয়াকে ব্যবহার করতে পারে। দলীয়ভাবে সে ফায়দা নিতে চাইবে। তারা বিচারও করবে, সেই সঙ্গে দলীয় স্বার্থটাও চরিতার্থ করতে চাইতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
হারুন-অর-রশিদ  আমি বিষয়টিকে এভাবে দেখতে চাই না। কারণ যুদ্ধাপরাধী কারা তা বাংলার মানুষ জানে। এখন সেসব লোক যদি কোনো রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে সুবিধা নিতে চায় তাহলে তা তাদের নিতে দেওয়া যাবে না। সে কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে রাজনৈতিক লক্ষ্যে ব্যবহারের একটা প্রচারণা কিন্তু থাকবে। আমরা বলি, কে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর কে নয় তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। পরিচয় যা-ই থাক, তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। যুদ্ধাপরাধীরা রাজনৈতিক দল করে বলে তাদের বিচার হবে না, তা তো হতে পারে না।
প্রথম আলো  যুদ্ধাপরাধী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে পারে।
হারুন-অর-রশিদ  হ্যাঁ, থাকতে পারে। তাতে অসুবিধার কিছু নেই। অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে। অনেকে তো এর অপব্যবহারও করতে পারে। একজন অপরজনের বিরুদ্ধে অহেতুক অভিযোগ তুলতে পারে। কিন্তু তার পক্ষে তো উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে হবে।
প্রথম আলো  তদন্তকাজে তথ্য ও প্রমাণ দিয়ে সহায়তা করতে আপনাদের কি কোনো সাংগঠনিক প্রস্তুতি আছে?
হারুন-অর-রশিদ  বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই আমরা কিন্তু ৫০ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির একটি তালিকা পেশ করেছিলাম। এটা একটা আংশিক তালিকা। তবে তাঁদের অপরাধের বিষয়ে আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।
প্রথম আলো  তাঁদের সবাই বাংলাদেশে আছেন?
হারুন-অর-রশিদ  হ্যাঁ, আছেন। কয়জন মারা গেছেন।
প্রথম আলো  আপনারা কি তবে যুদ্ধাপরাধীদের মরণোত্তর বিচারও চাইছেন?
হারুন-অর-রশিদ  অবশ্যই। অন্তত জাতি জানতে পারবে, তাঁরা কী করেছেন।
প্রথম আলো  কিন্তু প্রচলিত আইনে সে সুযোগ নেই।
হারুন-অর-রশিদ  তাঁদের বিষয়ে সব তথ্যই তো ফাইলে রয়েছে। নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে। তাঁদের বিচারের আওতায় না আনা হলে তাঁরা তো ক্লিন বিবেচিত হবেন।
প্রথম আলো  যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এ মুহূর্তে আপনাদের উদ্বেগ কী?
হারুন-অর-রশিদ  ইতিমধ্যে অনেক বিলম্ব ঘটেছে। বিচার দ্রুত শুরু হওয়া উচিত। এ মুহূর্তের উদ্বেগ হলো, তদন্তকারী সংস্থায় কারা আসছেন। তাঁরা কে কতটা একনিষ্ঠ ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেটা দেখার বিষয়। কারণ এখানে গলদ ঘটলে বিরাট বিপদ। তদন্ত সুষ্ঠু না হলে প্রসিকিউশন দুর্বল হবে। তারা দুর্বল হলে বিচারেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই এই সংস্থার সফলতা-ব্যর্থতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
হারুন-অর-রশিদ  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.