স্বাধীনতা-বাঙালির রাষ্ট্র-সাধনা by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বাংলাভাষী অঞ্চলের মানচিত্র অসংখ্যবার বদলেছে। বাংলাদেশে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব, সেই সব রাজ্যের ওপর ঘন ঘন বহিরাক্রমণ বহুবার সীমান্ত পরিবর্তন হওয়ায় বাঙালির কোনো রাজ্যিক বা রাজনৈতিক আনুগত্য বিকাশ লাভ করেনি। সমষ্টিচেতনার বড় অভাব ছিল বাঙালির।


বাঙালি চিন্তাবিদেরা ইউরোপীয় মানবতাবাদ, মার্কসবাদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার দর্শন, ইতিহাস ও তার ধারাবাহিকতার বৃত্তান্ত চর্চা করেন, কিন্তু বাঙালির বা বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা ও স্বাধীনতার জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো চিন্তাভাবনা করেননি। প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রমথ চৌধুরী প্রমুখ স্বল্প কয়েকজন ব্যক্তি বাঙালিদের স্বার্থের কথা বললেও বাঙালির স্বাধীনতার কথা তেমন উচ্চকণ্ঠে কেউ বলেননি। তখন রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, যা ইউরোপীয় চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত ও জারিত ছিল—সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা হতো।
নিজেদের ‘বাংলাজাতি’ বলে উল্লেখ করলেও রবীন্দ্রনাথ কখনো কল্পনাতেও ভারত হতে বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা জাতি বা রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করেননি। দক্ষিণ এশিয়ায় নজরুল ইসলামই প্রথম সাহিত্যিক যিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা বলেন এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের স্বপক্ষে ডাক দেন।
‘জয়বাংলা’ বললেও নজরুলের ‘ভারত-লক্ষ্মী’ বা ‘ভারত জননী’র প্রতি আনুগত্য ছিল অম্লান। তাঁর স্বপ্ন ‘ভারত মহাভারত হবে’ এবং যেদিন পীড়িত মানুষের প্রতিকারে প্রাণে সাড়া জাগবে, ‘মহা-মানুষের সেদিন সৃষ্টি হবে।’
প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বাঙালির পেট্রিয়টিজম’-এ বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রশ্নে বৃহত্ ভারতের ভূমিকাকে সাম্রাজ্যবাদী বলে চিহ্নিত করে উল্লেখ করেন যে ‘ইউরোপের কোনো জাতির সঙ্গে অপর জাতির সে-প্রভেদ নেই, আমাদের এক জাতির সঙ্গে অপর জাতির যে-প্রভেদ আছে।’
১৯২৭ সালে সরাসরি স্বতন্ত্র বাঙালি রাষ্ট্র গঠনের কথা না বলে এয়াকুব আলী চৌধুরী প্রশ্ন করেন, ‘ভৌগোলিক সীমা, ভাষা, আবহাওয়া ও আহার-পরিচ্ছদের বিভিন্নতায় ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রমণ্ডল গড়িয়া উঠিয়াছে। ...সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও রাজ্য গঠনের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কি শুধু ভারতবর্ষে বিফল বলিয়া প্রমাণিত হইবে?’ এস ওয়াজেদ আলী তাঁর ভবিষ্যতের বাঙালি গ্রন্থে স্বতন্ত্র বা স্বাধীন বাংলার ধারণার সবচেয়ে কাছাকাছি কিছু বক্তব্য দেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরত্চন্দ্র বসুর অবিভক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাব প্রথম থেকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কলকাতা, বিহার ও নোয়াখালীর দাঙ্গার পরিবেশে সার্বভৌম অখণ্ড বাংলার পরিকল্পনা হিন্দু ও মুসলমান কেউই স্বীকার করে নেয়নি। ১৯৪৭ সালের আগেই বঙ্গপ্রদেশের হূদয় দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। বৃহত্তর বঙ্গের প্রতি বাঙালিদের তেমন দরদ ও টান ছিল না। বঙ্গপ্রদেশের উল্লেখযোগ্য হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও সমাজপতিরা বঙ্গপ্রদেশের বিভক্তির জন্য ব্রিটেনের সেক্রেটারি অব স্টেটের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন।
১৯৪৬-৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত সাম্রাজ্যের বঙ্গপ্রদেশে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়। সেই কথা বাদ দিলে বলতে গেলে, বাংলার স্বাধীনতার কথা কেউ আগে উচ্চারণ করেনি। বাংলা ভাষায় স্বাধীনতার কথা লেখা হলেও সে স্বাধীনতা বাংলার স্বাধীনতা নয়। ১৯৪৭ সালের আগে মুসলমান বা হিন্দু যাঁরাই স্বাধীনতার কথা বলেছেন, তাঁরা নিখিল ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে তা বলেছেন।
১১ আগস্ট, ১৯৪৭ দ্বিজাতিতত্ত্বের জনক জিন্নাহ বললেন, ‘পাকিস্তানকে একটা জাতি হতে হবে। রাজনৈতিক দিক থেকে হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমান আর মুসলমান থাকবে না, সকলে মিলে হবে এক রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিক।’ রাষ্ট্রনায়কের মতো কথা। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে দ্বিজাতিতত্ত্বের ইমারত পাকিস্তানের জন্মের আগেই পরিবর্তিত হয়ে গেল। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হিসেবে জোর গলায় পাকিস্তানের পক্ষে বলা অসম্ভব ছিল যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান দুই জাতি স্বতন্ত্রভাবে বিরাজমান।
১৯৫৬ সালের অক্টোবরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী বললেন, ভারত বিভাগের জন্য যে দ্বিজাতিতত্ত্ব যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, তা পাকিস্তান জন্মের পরই ভেঙে গেছে। মিল্লাত-ই-ইসলামের ভাবাদর্শ ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে, কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র ভৌগোলিক সীমারেখায় সীমিত এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র।
২৫ আগস্ট, ১৯৫৫ সাল পাকিস্তান গণপরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান ও পূর্ব বাংলার বেশির ভাগ নেতা ‘পূর্ব বাংলা’ নামের বিলুপ্তির বিরোধিতা করলেও মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামপন্থীরা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামের বিরোধিতাকে পাকিস্তান আদর্শ বর্জনের সমতুল্য বিবেচনা করে তুমুল হইচই করেন।
১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনার জন্য জগন্নাথ কলেজ, ইডেন কলেজ ও তোলারাম কলেজের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী উদ্যোগী হয়ে এক শপথনামায় রক্ত স্বাক্ষর প্রদান করে অপূর্ব সংসদ গঠন করেন। সংসদের ‘অ’, ‘পূ’, ‘ব’, ‘স’—‘অক্ষরগুলো অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকারে’র পরিবর্তে ব্যবহূত হয়। সংক্ষিপ্ততর নাম ছিল ‘অপু’, যার নামে সংসদের ইশতেহার ও পুস্তিকা প্রকাশিত হতো।
অপূর্ব সংসদের তরুণেরা দেশে-বিদেশে East Pakistan Forever বলে দেশপ্রেমের কথা বলেন। ষাটের দশকের শেষার্ধে লন্ডনে থাকার সময় আব্দুল আজিজ বাগমার East Pakistan for East Pakistan, Withdraw occupation troops from East Pakistan বা For East Pakistan full autonomy or freedom: Freedom—এ ধরনের ব্যানার হাতে করে শোভাযাত্রা করেছিলেন। ৭ এপ্রিল, ১৯৬৯ সালে লন্ডনের টাইমস-এ সেই ব্যানারে ছবিসহ শোভাযাত্রার এক ফটো প্রকাশিত হয়।
পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফ ‘অপু’র তৃতীয় ইশতেহার ইতিহাসের ধারায় বাঙালিতে বলেন, ‘জাতীয় সঙ্গীত হচ্ছে বল, বীর্য, প্রেরণা ও আদর্শের উত্স। আমাদের সেই জাতীয় সঙ্গীত রচিত হয়েছে জনগণের অবোধ্য ফারসি ভাষায়। অধিকাংশ পাকিস্তানিদের প্রাণের যোগ নেই সে-কওমী সঙ্গীতের সঙ্গে।’ ইশতেহারের শেষাংশে ছিল ‘আমার সোনার বাংলা।’ অপূর্ব সংসদের প্রচেষ্টায় গানটির প্রচারে ব্যাপ্তি ঘটে। স্বাধীনতার পর সংবিধানে এই গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
১ অক্টোবর, ১৯৬৫ ড. আহমদ শরীফ রচিত অপুর তৃতীয় ইশতেহার ইতিহাসের ধারায় বাঙালি প্রকাশিত হয়। ড. আহমদ শরীফ বলেন, ‘আমরা এ দেশেরই জলবায়ু ও মাটির সন্তান। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এ দেশের মাটির পোষণে, প্রকৃতির লালনে এবং মানুষের ঐতিহ্য-ধারায় আমাদের দেহ-মন গঠিত ও পুষ্ট। আমরা এ দেশেরই অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর বংশধর। আমাদের জাত আলাদা, আমাদের মনন স্বতন্ত্র, আমাদের ঐতিহ্য ভিন্ন, আমাদের সংস্কৃতি অনন্য। আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। ভাষার নাম বাংলা। তাই আমরা বাঙালি।’
উপসংহারে বলা হয়, ‘যে অর্থনৈতিক কারণে হিন্দুবিদ্বেষ জেগেছিল এবং ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিগত স্বাতন্ত্র্যের জিকির তুলে আর্থিক সুবিধার জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত; আজ আবার সেই অর্থনৈতিক কারণে অর্থাত্ শোষণের ফলেই বাঙালি স্থানিক, ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে স্বাধীনতা দাবি করবে এই তো স্বাভাবিক। অন্তত ইতিহাস তো তা-ই বলে।’
১৬ জানুয়ারি ১৯৬৫ সালে আবুল মনসুর আহমদ বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানি এক অংশ ব্যতীত ধর্ম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌথ অভিজ্ঞতা ছাড়া দুই পাকিস্তানের মধ্যে কোনো সাদৃশ্য নেই। ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পোশাকাদি, রীতি-রেওয়াজ, খাদ্যাভ্যাস, পঞ্জিকা, মান সময় সব আলাদা। জাতিগঠনের ন্যূনতম অপরিহার্য উপাদানগুলো পাকিস্তান রাষ্ট্রে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।’
৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ লাহোরে শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সংবাদপত্রে এই শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব প্রকাশিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের আইন ও পার্লামেন্টারি দপ্তরের মন্ত্রী আবদুল হাই চৌধুরী ছয় দফাকে ‘দেশদ্রোহিতার নামান্তর’ বলে অভিহিত করেন। ১০ মার্চ ১৯৬৬ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান হুমকি দিয়ে বলেন, ‘ছয় দফার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ চাপাচাপি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে এবং দেশে গৃহযুদ্ধ হয়ে যাবে।’
ইতিমধ্যে লোকায়ত ইউরোপীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত নতুন প্রজন্ম প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বাদ দিয়ে সার্বভৌম স্বাধীনতার কথা চিন্তা করতে শুরু করেছে।
‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা কি স্বাধীন থাকতে পারবে?’—এমন সংশয় মনে থাকলেও স্বাধীনতাকামী সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাধারা ক্রমে দেশে দ্রুত ব্যাপ্তি লাভ করে। বিদেশে লন্ডনের ইস্ট পাকিস্তান হাউসে স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যে আলোচিত হতো। সামরিক বাহিনীতে কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তাও পাকিস্তাননামীয় বিষবৃত্ত থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে এই লেখকের যে আলোচনা হয়, তা থেকে মনে হয় না, পাকিস্তান সরকারের অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট ছিল। সার্জেন্ট জহুরুল হক তো পাকিস্তান-দ্রোহিতার অভিযোগের উত্তরে কসুর-কবুল করতে চেয়েছিলেন। দেশের লোক অবশ্য এই ষড়যন্ত্রকে বিশ্বাস করেনি, যদিও অনেকে ভেবেছিলেন, এমন ষড়যন্ত্র হয়ে থাকলে ভালোই হয়েছে।
পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে যদি উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলমানদের মতো দোলাচলচিত্ততা থাকত, তা হলে পাকিস্তানের জন্ম হতো না। পাকিস্তানের জন্ম না হলে সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ১৯৭১ সালে সম্ভব হতো কি না, সেই ফাটকা তর্কে আমি কালক্ষয় করতে চাই না। এ দেশের লোক যে কারণে পাকিস্তান চেয়েছিল, তার চেয়ে গভীরতর মূল্যবোধে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প রাজনৈতিক কাঠামোয় তাদের মঙ্গল নেই। তাদের স্থিতি ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্যে যে ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্ট হয় সেই পথে আমাদের অগ্রজদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল আড়ষ্ট ও সংকোচপূর্ণ। কিন্তু দ্রুত পটপরিবর্তন হতে শুরু করে।
১৪ আগস্ট ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালে ১ মার্চ সব ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে অবাঙালি আমলা ও পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যোগাযোগে। ১ জুলাই ১৯৭০ থেকে তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিটের অবসান ঘটে। পশ্চিম পাঞ্জাবের নতুন নাম হয় পাঞ্জাব। পূর্ব পাকিস্তান বাংলা, এমনকি পূর্ব বাংলাও হলো না। পাকিস্তানিদের কাছে ‘বাংলা’ ও ‘দেশ’ দুটো শব্দই ছিল বড় অবাঞ্ছিত।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে আবার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ নির্বাচনের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে আমূল পরিবর্তনবাদী র্যাডিক্যাল বাংলার যুবকেরা যে রণধ্বনি তুলেছিল—‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, সে এক অভিনব ব্যাপার। ভুট্টো বুঝতে ভুল করেননি, যখন ২৫ মার্চ ১৯৭১ তিনি বলেন, ‘ওদের দাবি তো স্বাধীনতার চেয়ে বেশি, প্রায় সার্বভৌমত্বের কাছাকাছি।’ সামরিক জান্তাও ভুল করেনি। তাই তারা স্বাধীনতার কথা যেখানে উচ্চারিত হতো, সেই একুশে মিনার গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ২৬ মার্চের রাতে।
২ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের ছাত্রসভায় প্রথম স্বাধীন বাংলার যে পতাকা উত্তোলিত হয়, তার মধ্যেও পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ছিল। বাঙালি তরুণেরা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘হয় ছয় দফা, নয় এক দফা।’ খুব দ্রুত সেই স্লোগানের রূপান্তর ঘটে—‘ছয় দফা নয়, এক দফা এক দফা।’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’—সেই অভিনব রাজনৈতিক আহ্বানে বাঙালি অভূতপূর্ব উত্সাহ ও উন্মাদনায় সাড়া দিয়েছিল। প্রণোদনার সেই আকস্মিক পরিবর্তনেই যেমন সাহসিকতা তেমন সহজতা ছিল। সারা দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরাও প্রতিযোগিতায় নামল স্বাধীনতার পক্ষে যোগ দেওয়ার জন্য।
২৬ মার্চ ১৯৭১ চট্টগ্রামে মুখে মুখে এই খবর প্রচার হয় যে সেই রাতে ‘প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা’ যুদ্ধের প্রস্তুতিকল্পে শক্তি সংহত করার জন্য শেখ মুজিব এক বাণী পাঠিয়েছেন। ২৭ মার্চ বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কালুরঘাট থেকে ‘মহান নেতা ও বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে’ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার এক ঘোষণাপত্র প্রচার করেন। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ ‘সার্বভৌমিক ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক নির্বাচিত প্রতিনিধিরা’ বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান মুজিবনগরে) এক গণপরিষদ গঠন করে বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন।
সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন এক অভাবিত সমর্থন পায়। সেই সংগ্রামের এমন একটা স্বতঃস্ফূর্তি ছিল যে তখন ‘জাতীয়তাবাদ’-এর কথা বিশেষভাবে উচ্চারণ করার প্রয়োজন হয়নি। সেই আত্মরক্ষামূলক মুক্তি আন্দোলন কোনো সম্প্রসারণবাদ বা বিমোচনবাদের দ্বারা ভাবিত বা পরিচালিত হয়নি।
যে দেশের মাটিতে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঋদ্ধিবৃদ্ধি ঘটবে, স্বাধীনতার আগে আগে সে দেশের নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’। সেই নাম সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার পরিলেখ-বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের দেশের ‘বাংলাদেশ’ নামকরণে পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বড় অসন্তুষ্ট হন। এ বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কূটনৈতিক প্রতিবাদ করা সমীচীন মনে করে তাঁরা ক্ষুব্ধ মন্তব্য করেন। বাংলাদেশকে নীরদচন্দ্র চৌধুরী ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ ও ‘মুসলমানদের বাংলাদেশ’ বলে আখ্যায়িত করেন।
‘বঙ্গ’ শব্দের সঙ্গে বাংলাদেশের নাড়ির সম্পর্ক। ইতিহাস-ভূগোলে পরিচিত ‘বাংলাদেশ’-এর উত্সভূমি, হূেকন্দ্র ও চারণভূমির বৃহদংশ তো বর্তমান বাংলাদেশের পরিধির মধ্যে বিরাজমান। আমাদের দেশের নাম তার ভাষার নামে নাম। এমন যৌগপদ্য সৌভাগ্যের কথা। এই দেশের স্বাধীনতার বীজ নাকি এর ভাষার মণিকোঠায় সঙ্গোপনে রক্ষিত ছিল।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।

No comments

Powered by Blogger.