রাজনৈতিক সংস্কৃতি-একজন চার্লস দ্য গলের অপেক্ষায় by সৈয়দ বদরুল আহ্সান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কথা। ইদানীং লক্ষ করেছি যে এ দেশে এমন মানুষ রয়েছেন এবং বিদেশেও এমন কিছু বাঙালি আছেন, যাঁরা সর্বদা প্রস্তুত থাকেন আপনাকে, আমাকে এই উপদেশ দেওয়ার জন্য যে আমরা যেন জাতির পিতাকে নিয়ে এত বেশি না লিখি।


এই সেদিন দেখলাম, কিছুসংখ্যক পাঠক, যাঁদের ইতিহাসবোধ খুবই সীমিত বেশ হতাশায় রয়েছেন আমি কেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বারবার লিখে যাই। এঁদেরই একজন আমাকে বলেই দিলেন যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে না লিখে দেশের আরও যে কত বড় বড় সমস্যা রয়েছে, সেগুলোর দিকে দৃষ্টি দিই না কেন। তাঁর উপদেশ ভালো। তবে মনে হয় তাঁর মতো অনেকেই আছেন, যাঁরা হয় ইতিহাস এখনো আয়ত্তে আনতে পারেননি অথবা শেখ মুজিবুর রহমান যে কত বড় মনের ও মাপের মানুষ ছিলেন, সেই সত্যটি উপলব্ধি করতে এখনো পারেননি। আবার এঁদেরই মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা বারবার বলে যাবেন। তবে বঙ্গবন্ধুর অবদানের বিষয়টি নিয়ে বিরক্তি বোধ করেন। এই শ্রেণীর মানুষ ভুলে যান যে আজ আমরা বাঙালিরা যে স্বাধীন জাতি হিসেবে গর্ববোধ করি, বিদেশে যাই এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাঙালি হয়ে কথা বলতে পারি—এ সবকিছুর পেছনেই রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি।
এই বাস্তব সত্যটি অবশ্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সেই মহিলা সাংসদ বুঝে উঠতে পারেননি, যিনি এই কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর জানাজা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর উক্তিতে আমরা গোটা জাতি হিসেবে লজ্জা বোধ করেছি, আমাদের মাথা নিচু হয়েছে। একইভাবে যখন বঙ্গবন্ধুকে তাঁর চেয়ে ছোট আকারের ব্যক্তিত্বের কাতারে যোগ দেওয়ানো হয়, তখন আমাদের ওই একই প্রশ্ন জেগে ওঠে—যাঁরা এই কাজটি করেন, তাঁদের ইতিহাসজ্ঞান কী এতই সীমিত? তাঁরা কি মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, নাকি দেখেও স্বেচ্ছায় ভুলে গেছেন সেই ইতিহাস? যে বাঙালি, যে এ দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তিনি তো ইতিহাসবিমুখ হবেন না। বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু, মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযুদ্ধ—এ সবই অম্লান হয়ে থাকবে। বলতে পারেন যে যদি ইতিহাস সত্যকেই সমুন্নত রাখবে, তাহলে আমরা এত চিন্তিত কেন? চিন্তিত এই জন্য যে যাঁরা দেশের ইতিহাস বিকৃতিতে এত বছর ধরে ব্যস্ত রয়েছেন, তাঁরা এমন একটি শ্রেণী তৈরি করে যাচ্ছেন, যাঁরা একদিন হয়তো নিজ দেশ সম্বন্ধে কিছুই জানবেন না ও বুঝবেন না। যেমন ওই সব ব্যক্তি, যাঁরা প্রশ্ন করেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত বলার ও লেখার কী আছে। অন্য সবার মতো তাঁদের অবশ্যই রাজনৈতিক মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। তবে নিজের অতীত, নিজ দেশের ইতিহাস না জানাটা উন্নত মানসিকতার লক্ষণ হতে পারে না।
ইতিহাস-বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আরও অনেক কথা চলে আসে। এ মুহূর্তে যেমন ইতিহাসকে সমুন্নত রাখা আমাদের সবারই একটি গুরুদায়িত্ব, তেমনি এটাও লক্ষ রাখা প্রয়োজন যে আমরা এমন কোনো কথা না-বলি বা এমন কাজ না-করি, যার কারণে আমাদেরকে লজ্জিত ও অপ্রস্তুত হতে হয়। জাতীয় সংসদে সরকারি দলের কী প্রয়োজন ছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে প্রশ্ন তোলা? চন্দ্রিমা উদ্যানে তাঁকে শায়িত করা হয়েছে, নাকি অন্য কাউকে, নাকি সেখানে কোনো মরদেহই নেই—এসব প্রশ্ন তো গণতান্ত্রিক রাজনীতির উপাত্ত হতে পারে না। এরপর রয়েছে আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি। সেই শৈশব থেকে আমরা জেনে এসেছি যে মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা ভালো নয়। হ্যাঁ, যদি সেই ব্যক্তির রাজনীতি নিয়ে কথা উঠে, আমরা তাঁর সমালোচনা করব। তবে সেটা এমন ভাষায় করব, যাতে করে সেটা কোনোক্রমেই ব্যক্তিগত আক্রমণে পরিণত না হয়। এখন যদি কোনো সাবেক মন্ত্রী বলে ফেলেন যে ডিএনএ (DNA) পরীক্ষা করে যাচাই করা দরকার, ওই চন্দ্রিমা উদ্যানের কবরে জিয়াউর রহমানের লাশ রয়েছে কি না, তখন আমাদের দুঃখ হয়। প্রশ্ন করি একে অন্যজনকে, গণতন্ত্র কি আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে? দেশের বৃহত্তর আদালত তো আমাদের জানিয়েই দিয়েছেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই করেছেন। এটাও বলা হয়ে গেছে যে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল থেকে এপ্রিল ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত যেসব সরকারের এ দেশে উত্থান হয়েছিল, সেসব সরকার ছিল অবৈধ এবং যথার্থ কারণেই। জাতিগতভাবে এসব রায়ের ব্যাপারে আমরা সন্তুষ্ট। এ নিয়ে তো রাজনীতি করার কিছু নেই। হ্যাঁ, সংসদে বিরোধী দল ভালো ভূমিকা রাখছে না, হয়তো রাখতে চায় না। ক্ষমতা হারিয়ে বিরোধীদলীয় সদস্যরা নতুন পরিস্থিতিটা মেনে নিতে পারছেন না। এটা তাঁদেরই ব্যর্থতা; কিন্তু তাই বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেন এমন কাজ করবে, যা নাকি রীতিমতো উসকানির পর্যায়ে চলে যায়?
বিগত তিন মাস দেশের বাইরে অবস্থান করেছি। দেশে কী হচ্ছে এবং কী হওয়া উচিত—সেই বিষয় অন্য যেকোনো বাঙালির মতো ভেবেছি। সবসময় একটি কথাই মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের মানুষ এত ভালো, এত দরিদ্র, এত সহজ-সরল কিন্তু এদের ভাগ্যে ভালো উদারমনা নেতৃত্ব আসে না কেন? সংসদের সভায় বিভিন্ন এলাকার সাংসদ বেশি সময় কাটান ঝগড়া করে। সময় ব্যয় করেন অতীত নিয়ে। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার সাংসদ ১৪ মাসে তাঁদের অঞ্চলের জন্য কী কাজ করেছেন, কী উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন সেই বিষয়ে আমরা জানি না। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের বাড়িঘর কারা পুড়িয়ে দিয়েছে এবং তাদের কেন আজ পর্যন্ত ধরা হয়নি, সে বিষয়ে অন্যদের মতো ভেবেছি। যখন বিরোধী দল বলে যে পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী স্থায়ীভাবে থাকলে সেখানে শান্তি বজায় থাকবে, তখন অবাক হতে হয়। আমরা বাঙালি হয়ে আদিবাসীদের ওপর যা নিপীড়ন চালিয়েছি, সে তো অস্বীকার করা যায় না। এই যে বাঙালিরা আদিবাসীদের এলাকায় বসতি স্থাপন করে আসছে সেই ১৯৮০-এর দশক থেকে, সেটার কি এত প্রয়োজন ছিল? অতি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকে বলতে পারি, বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক দেশের যেকোনো অঞ্চলে বসবাস করতে পারে, তার অধিকার হিসেবে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হলো যে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। এটা আমাদেরই চরম ব্যর্থতা যে ১৯৭২-এর সংবিধানে আমরা আদিবাসীদের ঐতিহ্য, তাদের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা করার বিষয়টি তুলে ধরিনি। সবাইকে অভিহিত করেছি বাঙালি বলে। এতে যা হয়েছে, তা আমাদের সবারই জানা। এখন সময় এসেছে, এই পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য জায়গার আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার ও অবস্থান নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার। যখন শুনি কাউকে বলতে যে পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ীভাবে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা দরকার, তখন তাকে বলে দেওয়া প্রয়োজন যে একটি সভ্য জাতি অন্য একটি সভ্য সংস্কৃতিকে এভাবে দাবিয়ে রাখতে পারে না। আমরা ফিলিস্তিনিদের কথা বলি, কুর্দিদের কথা বলি, দারফুর নিয়ে চিন্তিত, তিব্বত নিয়ে উদ্বিগ্ন অথচ আমাদের নিজ দেশে আদিবাসীদের জীবন নিয়ে ভাবতে চাই না। আবার সেই ইতিহাসকে উপেক্ষা করা?
দেশকে নিয়ে আমাদের অনেক বলার আছে। স্থানীয় সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে অনেক কথা বলার আছে। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে আনমনেই নিজেকে প্রশ্ন করি—আমাদের এই সমস্যাজর্জরিত বাংলাদেশে কি জেনারেল চার্লস দ্য গলের মতো বড় মাপের রাষ্ট্র এবং সরকারপ্রধানের উদ্ভব কোনোদিন হবে না?
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.