বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-আসছে বর্ষা বাড়ছে শঙ্কা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদ-নদী কালক্রমে এত বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, তা হয়তো ভাবনার অতীতই ছিল। একদিকে নদ-নদী হারিয়ে যাচ্ছে, নাব্যতা সংকটে নদ-নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে, অন্যদিকে নদীভাঙনে সর্বহারা মানুষের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।


নদীভাঙন বাংলাদেশের নতুন কোনো সমস্যা না হলেও ক্রমান্বয়ে এর রূপ প্রকট হচ্ছে এবং এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব সমাজজীবনে কালো ছায়ার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে- এটি হলো রূঢ় বাস্তবতা। এখন আর নদীপাড়ের মানুষজনই শুধু নয়, নদীর তীর থেকে দূরবর্তী মানুষজনও এই বিপর্যয়ের শিকার। নদীভাঙনের কবলে পড়ে কত সম্পন্ন পরিবার পথে বসে গেছে, নগর-মহানগরে ভাসমান মানুষের খাতায় নাম লিখিয়েছে- এর সঠিক পরিসংখ্যান মেলা ভার হলেও এই সংখ্যা যে বিপুল, তা ধারণার বাইরে নয়। মুন্সীগঞ্জের বিল্লাল আলীর চার সদস্যের পরিবারটি এখন উদ্বাস্তু। ঢাকা মহানগরীর একটা বস্তির খুপরি ঘর এখন তার অস্থায়ী ঠিকানা। রিকশা চালিয়ে কোনোরকমে অসুস্থ স্ত্রী আর দুটি সন্তান নিয়ে কাটছে তার দুর্বিষহ জীবন। অথচ কয়েক বছর আগেও তার ছিল আনন্দ-ভৈববের সংসার। কয়েক দিন আগে বিল্লাল আলীর রিকশায় উঠে জানা গেল তার এই মর্মন্তুদ কাহিনী। এমন বিল্লাল আলীর সংখ্যা এই বাংলাদেশে অনেক।
আমাদের দেশের উদ্বাস্তু ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই নদীভাঙনের শিকার। গ্রামীণ দারিদ্র্যের অন্যতম কারণও এই সর্বনাশা নদীভাঙন। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, প্রতিবছর দেশের প্রায় আড়াই লাখ মানুষ নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে এবং প্রায় ১০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবছর নদ-নদীর বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ফসলহানিও ঘটছে। নদ-নদীর ভাঙনে প্রতিবছর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙন প্রকট হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমেও তা থেমে থাকে না। নদীমাতৃক বদ্বীপে এই নদীই হয়ে উঠছে সর্বসংহারী। ভাঙনের সমস্যা কমবেশি সারা দেশেই বিদ্যমান। শুধু বড় নদীগুলোর পাড়ই ভাঙছে না, ভেঙে চলেছে ছোট নদীগুলোর পাড়ও। ৬ মে ২০১২ কালের কণ্ঠে প্রকাশ, বর্ষা মৌসুম যতই ঘনিয়ে আসছে, রংপুরের তিস্তার চরের মানুষের শঙ্কা ততই বাড়ছে। প্রতিবছরই তিস্তা নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে একের পর এক জনপদ। সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় স্বাধীনতার পর থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোটি কোটি টাকা খরচ করেও স্থায়ীভাবে তিস্তার ভাঙন রোধ করতে পারছে না। তিস্তার ভাঙনে বিভিন্ন বাঁধ, উপবাঁধ ও বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ডান তীর অর্থাৎ মূল বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। এতে বাঁধে আশ্রিত ১০ সহস্রাধিক পরিবারের আবারও আশ্রয়হীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিস্তাপাড়ের এমন চিত্র এই জনপদে আছে আরো অনেক।
মহাজোট সরকার নদীশাসন ও সংস্কারের মাধ্যমে ভাঙন ও বন্যার পুরনো সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও নদীশাসন নামের ওই প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৯টি নদীর এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার খনন করার কথা ছিল। পাশাপাশি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল বাঁধ নির্মাণ ও সংরক্ষণ পরিকল্পনা। প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ ওই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কতটা কী হয়েছে, তা জানা যায়নি। স্মরণযোগ্য, ১৯৯৩ সালে সরকার নদীভাঙনকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করার পর প্রতিবছরই এ খাতে বরাদ্দ বেড়ে চলেছে। কিন্তু বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন আছে বিস্তর। প্রমত্তা পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর ভাঙন ঠেকাতে বছরের পর বছর বরাদ্দ বেড়ে চললেও এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয় নয়। অভিযোগ আছে, নদীভাঙন ঠেকানোর নামে রাজনৈতিক স্বার্থে হাজার হাজার কোটি টাকার কিছু অংশ মানুষকে রক্ষার নামে পানিতে ফেলা হচ্ছে, বাকিটা ব্যক্তি বা মহলবিশেষের উদরপূর্তির কাজে লাগছে। অন্যদিকে ভাগ্যবিড়ম্বিতদের তালিকা দীর্ঘ হয়ে চলেছে। নদী যখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে, তখন এর দুই তীরবর্তী জনমানুষের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। ভাঙনরোধে করণীয় নির্ধারণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার মেধা-বুদ্ধির সর্বোচ্চ প্রয়োগ এবং সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন জরুরি হলেও এই পরিচয়গুলো পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। গত চার দশকে নদীভাঙন রোধে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা কাগজপত্রে ব্যয় হলেও এর কত অংশ প্রকৃতই কাজে লেগেছে- এ এক অন্তহীন প্রশ্ন। শুধু অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধিই যদি ভাঙন রোধের একমাত্র কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয়, তাহলে আর বলার কিছু নেই। সন্দেহ নেই, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সুপরিকল্পনার ভিত্তিতে বরাদ্দ অর্থের অপচয় ও চুরি রোধ করার ওপরই মূলত সাফল্য নির্ভরশীল।
জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে নানা প্রাকৃতিক বালা-মুসিবত বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে নদীভাঙন সমস্যার স্থায়ী সমাধান সহজ না হলেও খুব যে দুরূহ, তাও কিন্তু নয়। নদীভাঙন সমস্যা এবং এ থেকে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় আমাদের দেশে এক রূঢ় বাস্তবতা। নদীভাঙনের শিকার সর্বহারা জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে পরিকল্পিত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতির বৃত্তবন্দি হয়ে আছে। কার্যত কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। বিপন্ন-বিপর্যস্তরা শুধু আশ্বাস-প্রতিশ্রুতিই শোনে, তাদের জীবনচিত্র বদলায় না। এই বিপন্ন জনগোষ্ঠী শুধু অমানবিক জীবন যাপনই করছে না, তারা সমাজের জন্য বোঝা হয়েও দাঁড়াচ্ছে। নদীভাঙন ও নানামুখী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ যে অমানবিক জীবন যাপন করছে, তা সভ্যতা-মানবতার কলঙ্কও বটে। বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির যুগে নদী ভাঙন রোধ করা যাবে না, তা মেনে নেওয়া কষ্টকর। সমস্যা আসলে অন্যত্র এবং সচেতন মানুষ মাত্রই এসব সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞাত। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও তা ভালো করেই জানেন। কিন্তু এ জন্য যে দাওয়াই দরকার, তা প্রয়োগেই যত বিপত্তি। বলা যাবে না যে নদীভাঙন থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা-চরিত্র নেই। বাঁধ-স্পার দিয়ে, বোল্ডার ফেলে যেখানে যেভাবে সম্ভব ভাঙনরোধে কিছু কিছু প্রয়াস অবশ্যই আছে। কিন্তু এমন টোটকা দাওয়াইয়ে এত বড় রোগ সারানো সহজ নয়। এ সমস্যা থেকে স্থায়ীভাবে পরিত্রাণের উপায় অবশ্যই খুঁজে বের করা সম্ভব। নদীগুলো থেকে অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। নদ-নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে দিতে নিয়মিত ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। নদীশাসনেও নিতে হবে বৈজ্ঞানিক পন্থা। প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে। প্রকৃতির ওপর যে নির্বিচার অত্যাচার চলছে, এরপর আর কত বোবা হয়ে থাকবে প্রকৃতি? দূষণ আর দখলের থাবা তো আছেই। মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের সব রকম অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডও এখানে বড় বেশি বেগবান। এ কারণেও নদ-নদী সময় সময় রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে, আর এর মূল্য দিতে হচ্ছে সমাজের একশ্রেণীর মানুষকে। নদী প্রকৃতিরই দান। এই নদীর চলার পথ বাধাগ্রস্ত হলে, নদ-নদীর রক্ষণাবেক্ষণ না করলে এর তীর ভাঙবেই। আর এ ভাঙনে বিপন্ন-বিপর্যস্তদের উদ্বেগজনক রূপ একদিন সব সম্ভাবনা গ্রাস করবে- এই সত্য এড়ানো দুরূহ।

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.