আমরা কেন অসুস্থ হই by ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ

আমরা অসুস্থ হই- এটা অত্যন্ত সহজ-সরল কথা। কিন্তু আমরা কেন অসুস্থ হই- এককথায় এর উত্তর দেওয়া সোজা কথা নয়। সৃষ্টির আদিকাল থেকে দার্শনিক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন এবং স্থানকালপাত্রভেদে পণ্ডিতরা তাঁদের নিজেদের মতো করে এর উত্তর দিয়েছেন।


পুরনো যুগে মানুষ মনে করত, রোগ-শোক হলো সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ। অনুন্নত জনগোষ্ঠীর মানুষ বহু রোগকে 'জিন বা ভূতের আছর' বলে আখ্যায়িত করে। প্রথম শতাব্দীর গ্রিক চিকিৎসাবিদ সেলসুস মনে করতেন, অসুস্থতার কারণ উদ্ঘাটন গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো রোগের চিকিৎসা। তাঁর আধ্যাত্মিক শিষ্য থিওফ্রেটাস বোম্বাসটুস হোহেনহাইম, যিনি পরে প্যারাসেলসুস নামে আখ্যায়িত হয়েছিলেন এবং একজন সফল চিকিৎসাবিদ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। মনে করতেন, উলি্লখিত কারণগুলো ছাড়া আরো কতগুলো ভিন্ন কারণ রোগ সৃষ্টির পেছনে কাজ করে। ওই কারণগুলো সংক্ষিপ্ত, সঠিক এবং অধিকতর বাস্তবসম্মত বলে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র মনে করে। প্যারাসেলসুস, যিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। মনে করতেন, রোগ উৎপত্তির পেছনে মূলত পাঁচটি কারণ কাজ করে। কারণগুলো হলো বহিরাগত (পরিবেশ), বিষ বা বিষাক্ত দ্রব্য (দূষিত দ্রব্যাদি), মনস্তাত্তি্বক (আবেগ প্রবণতা), বংশানুক্রমিক (জন্মগত) ও কর্মফলজনিত (আধ্যাত্মিক)। কারণগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।
এক. বহিরাগত কারণ : এসব কারণের মধ্যে রয়েছে তীব্র দাবদাহ, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, আর্দ্রতা, ভারি বৃষ্টি এবং আমাদের বর্তমান সময়ে আমরা যাকে বলি পরিবেশদূষণ, অম্লবৃষ্টি (এসিড রেইন), বিদ্যুৎ-চুম্বক গুণসম্পন্ন ক্ষেত্র (ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড), বায়বীয় কীটনাশক, কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যাদি, তেজস্ক্রিয় দূষণ বা বিকিরণ ইত্যাদি। সর্দিগর্মি বা হিমায়িত হওয়ার দরুণ দেহকলার জখম বা হিমদংশ অতিসহজে ডায়াগনোজ ও চিকিৎসা করা সম্ভব হলেও আধুনিককালের পরিবেশদূষণের কারণে সৃষ্ট রোগ চিহ্নিত করা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যাঁরা সরাসরি বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যাদি নিয়ে কাজকর্ম করেন তাঁদের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় তেমন জটিল হয় না। জীবাণু আরেক ধরনের বহিরাগত ফ্যাক্টর, যা মানুষকে অতিসহজেই সংক্রমিত করতে পারে। জীবাণু শরীরে ঢুকলেই রোগ হবে, তা সব সময় ঠিক নয়। জীবাণু শরীরে ঢুকলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ও জীবাণুুর আক্রমণ ক্ষমতার মধ্যে যুদ্ধ হয়। শরীর দুর্বল হলে অর্থাৎ শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল বা অকার্যকর হয়ে পড়লে এবং জীবাণু আক্রমণ বেশি প্রবল হলে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সুস্থ-সবল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে, রোগের প্রকোপ বা ব্যাপকতা কমে যায়।
দুই. বিষ বা ক্ষতিকর দ্রব্যাদি : এসব ক্ষতিকর পদার্থের মধ্যে রয়েছে পচা-বাসি খাবারদাবার, দূষিত খাবার বা পানীয়, বিষাক্ত দ্রব্যাদি, খারাপ, পরিশোধিত বা জাঙ্কফুড, রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা দূষিত খাবার, শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, গোশত, ফার্মাসিউটিক্যাল বা লাইফ-স্টাইল ড্রাগ, অ্যালকোহল, কফি, মাদক বা উত্তেজক-জাতীয় খাবার। তামাক, বিড়ি বা সিগারেট বর্তমান বিশ্বে স্বাস্থ্যঝুঁকি বা স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। ছোট শিশুদের জন্য উৎপাদিত পরিশোধিত খাবারের ফর্মুলা আজকাল অস্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এসব খাবার খেয়ে শিশুরা বেঁচে থাকে সত্যি, কিন্তু এসব ফর্মুলার খাবার শিশুদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা তেমন বাড়ায় না যেমনটি বাড়ায় মায়ের বুকের দুধ। প্রেসক্রিপশন ড্রাগের (যেসব ওষুধ কিনতে প্রেসক্রিপশন লাগে) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে, লাখো-কোটি মানুষ অসুস্থ হওয়া ছাড়াও বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে অসংখ্য জটিল রোগ সারাতে গিয়ে ক্ষতিকর ওষুধ গ্রহণ করে ব্যাপকহারে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে দুয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। রক্তে কোলেস্টেরল কমানোর স্ট্যাটিন-জাতীয় ওষুধ খেলে মাংসপেশির সমস্যা দেখা দেয়। অনেক ব্যথানিবারক ওষুধের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়, যার জন্য আবার ওষুধ খেতে হয়। সাধারণ ওষুধ প্যারাসিটামল ও অ্যাসপিরিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও বিপজ্জনক হতে পারে। ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ঘটনাকে আমরা খুব কমই ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে থাকি। এ প্রসঙ্গে দুই ধরনের ওষুধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। একটি হলো অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যটি হলো ভ্যাকসিন বা টিকা। রোগ সারানোর পাশাপাশি এই দুই ধরনের ওষুধই মানবসভ্যতার জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিন. মনস্তাত্তি্বক কারণ : মনস্তাত্তি্বক রোগের উৎপত্তির অন্যতম এক কারণ মানসিক চাপ। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মানসিক চাপ বা ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হতে পারে। ঘুমের মাধ্যমে আমাদের শরীরের ক্ষয় ও অন্য অসংগতিগুলো মেরামত হয়ে থাকে। সুতরাং পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর মেরামতের কাজে বিঘ্ন ঘটবে এবং নানা রোগের সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া আবেগপ্রবণ গোলযোগ, উত্তেজনা, অবদমিত অনুভূতি, রাগ-বিরাগ, অশান্তি, শোক, দুঃখ-কষ্ট, ভয়ভীতি মানুষকে দুর্বল করা ছাড়াও অসুস্থ করে তুলতে পারে। ডিপ্রেশন বা হতাশা আজকের বিশ্বের অন্যতম এক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী রোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট গ্রহণ করে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ হলেও এসব ওষুধের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। দীর্ঘ সময় ধরে এসব সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকলে মানুষ সমস্যাগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্রমান্বয়ে মানসিক সমস্যাগুলো অতিদ্রুত গুরুতর রূপ ধারণ করে এবং মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক রোগে পরিণত হয়। দুঃসংবাদ হলো, এসব মনস্তাত্তি্বক রোগের সঙ্গে শরীরের কিছু জটিল রোগ সরাসরি সম্পর্কযুক্ত হওয়ার কারণে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। যেমন- ক্ষোভ, রাগ, উত্তেজনা, মানসিক চাপ ইত্যাদির সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সরাসরি সম্পর্ক থাকার কারণে স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করছে।
চার. বংশানুক্রমিক : আমরা আমাদের মা-বাবা বা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে অনেক রোগ উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে থাকি। বংশানুক্রমিক বিজ্ঞান বলে, মা-বাবা কোনো রোগে ভুগলে সন্তানও সেই রোগের শিকার হবে। বংশগতভাবে প্রাপ্ত একটি রোগের উদাহরণ ডায়াবেটিস। এভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রোগের সত্যতা বা যথার্থতা নিয়ে ইদানীং বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে এবং এ সম্পর্কে বিজ্ঞান এখন অনেক যুক্তিবাদী তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করছে। মা-বাবার কোনো রোগ থেকে থাকলেও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ও অভ্যাস পরিবর্তনের ফলে আমরা আমাদের স্বাস্থ্যসমস্যা বহুলাংশে দূর করতে পারি। অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে মা-বাবাও তাঁদের সন্তানদের স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি সাধন করতে পারেন। সুষম খাবার গ্রহণ, ক্ষতিকর ওষুধ বা মাদক গ্রহণ বর্জন, নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করে মা-বাবা সন্তানের স্বাস্থ্যের ওপর বিরাট এক প্রভাব ফেলতে পারেন। মা ৯ মাস সন্তান পেটে ধারণ করেন। গর্ভাবস্থায় মায়ের চালচলন ও খাদ্যাভ্যাস শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, মা সুষম খাবার খেলে এবং সুস্থ ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করলে অসুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা বহুলাংশে কমে যায়।
পাঁচ. আধ্যাত্মিক : এই পর্যায়ে সেসব কারণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা ওপরের কারণের কোনোটিতে ফেলা যায় না। কোনো রোগের বৈজ্ঞানিক কারণ বা যুক্তি খুঁজে না পেলে এবং এসব রোগের প্রতিকারে কোনো বৈজ্ঞানিক যৌক্তিক ভিত্তি খুঁজে না পেলে তখন আমরা তাকে ভাগ্যের লিখন, অতীতের কর্মফল, কুকর্মের খেসারত অথবা অলৌকিক বিস্ময় হিসেবে মেনে নিই। এসব অবর্ণনীয় রোগ-বিমারির চিকিৎসায় মানুষ আধ্যাত্মিক চিকিৎসার শরণাপন্ন হয়। পীর-আউলিয়ার ঝাঁড়-ফুঁক, পানি পড়া, তাবিজ ও প্রার্থনার মাধ্যমে মানুষ এসব রোগের চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করে থাকে। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র কোনো কোনো রোগের প্লাসিবো (যে ওষুধে সক্রিয় উপাদান নেই) প্রয়োগ ও তার কার্যকারিতাকে স্বীকার করে। বর্তমান যুগেও কোনো কোনো চিকিৎসক কোনো কোনো কল্পিত রোগে অনেক রোগীকে প্লাসিবো ওষুধ প্রদান করে থাকেন এবং এতে ভালো ফল লাভ করা যায়। আত্মা বা মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক নিবিড়। মনের রোগে যেমন শরীর আক্রান্ত হয়, তেমনি শরীরের রোগের কারণেও মনের অসুখ হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিশেষে নিয়তি বা অদৃষ্ট সম্পর্কে চীনে প্রচলিত একটি ধারণা নিয়ে দু-একটি কথা বলি। এই ধারণাটি অন্ধবিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। বরং মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তির সুপ্তশক্তির সঙ্গে এর সম্পর্ক। মানুষ হিসেবে আমাদের কাজ হলো নিয়তির পরিপূর্ণতা প্রদান করা, এমন একটি বোধশক্তির উদ্ভাবন করা, যার মাধ্যমে আমরা নিজেদের চিনতে পারি। এ কাজটি করতে পারলে আমরা ভালো থাকব, আমাদের প্রেরণাশক্তি উৎসারিত হবে এবং আমরা এমন এক আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হব, যা আগে আমাদের কোনো সময় ছিল না। অন্যদিকে আমাদের চলার পথে ভয়ভীতি, দুশ্চিন্তা বা আত্মবিশ্বাসের অভাবে যদি কোনো বাধা আসে, আমাদের প্রেরণাশক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হবে এবং ফলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ব। সুতরাং রোগ-বিমারিকে জয় করার জন্য আমাদের মনোবল, আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণাশক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। তবেই শুধু সুস্থ থাকার যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারব।
লেখক : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসি ও ার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
drmuniruddin@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.