সাগর-রুনি হত্যায় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবার জড়িত : খালেদা by শফিক সাফি ও শরীফ আহ্্মেদ শামীম

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা জড়িত অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেছেন, 'এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বিরাট রহস্য রয়েছে। সরকারপ্রধান, তাঁর পরিবার ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দুর্নীতির তথ্য ছিল তাঁদের কাছে। সেগুলো প্রকাশ করে দিতে পারেন- এমন ভয়ে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে।


শুধু হত্যাই করেনি, আলামত নষ্ট করে দিয়েছে। এমনকি খুনিদের তাঁরা দেশের বাইরেও পাঠিয়ে দিয়েছে।'
দেশে হত্যা ও গুমের রাজত্ব চলছে- এ অভিযোগ করে বিএনপির চেয়ারপারসন আরো বলেন, আওয়ামী লীগ অতীত অপকর্মের জন্য ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে।
এবারের পর ৪২ বছরেও তারা ক্ষমতায় আসতে পারবে না। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে খুন-গুমের রাজনীতি বন্ধ করার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, 'অতীতে জঙ্গি দমন করেছি। ভবিষ্যতে গুম-খুন বন্ধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে।'
গতকাল শনিবার বিকেলে গাজীপুরের কাপাসিয়ার গাঘটিয়ারচালা মাঠে এক জনসভায় খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। পৌনে ৬টায় শুরু করে প্রায় ৩৫ মিনিটের বক্তব্যে তিনি সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপির কিছু অঙ্গীকারের কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ইলিয়াস আলীর মতো বিরোধী দলের নেতাদের টার্গেট করে হত্যা-গুম শুরু করেছে সরকার। এই লক্ষ্যে র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থার লোক, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সমন্বয়ে একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করেছে। কিন্তু গুম, খুন করে পার পাওয়া যাবে না। ভবিষ্যতে এর জন্য জবাব দিতে হবে।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন হলে ভরাডুবি হবে- এটা বুঝতে পেরেই তারা সংবিধান সংশোধন করেছে। জনগণ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে দাবি করে তিনি বলেন, বিদেশিরা পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছে। দেশের মধ্যে তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই। প্রতিবেশী একটি দেশে কিছুটা মাটি আছে। কিন্তু সেটাও ফাঁক হতে চলেছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ওই ফাঁক দিয়ে তারা অতলে তলিয়ে যাবে।
দেশে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, একজন মন্ত্রীর এপিএসের কাছ থেকে বস্তাভর্তি টাকা উদ্ধার করা হলো। ওই ঘটনার পর থেকে তাঁর ড্রাইভারের কোনো খবর নেই। পরে তাঁকে মন্ত্রী থেকে বাদ দেওয়া হলেও আবার মন্ত্রী করা হয়েছে। কারণ তিনি হুমকি দিয়েছেন, মন্ত্রী রাখা না হলে সরকারের অজানা তথ্য ফাঁস করে দেবেন। আবুল হোসেনের দুর্নীতির প্রমাণ হওয়ার পরও তাঁকে বাদ দেওয়া হয়নি। সরকারের দুর্নীতির কারণে সোহেল তাজ পদত্যাগ করলেও তা গ্রহণ করা হচ্ছে না। দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করে দেবে- এমন ভয়ে সরকার মন্ত্রীদের বাদ দিতে সাহস পাচ্ছে না। অথচ আমাদের সময় অনেককে বাদ দেওয়া হয়েছে।'
খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বেইমান, দুর্নীতিবাজ ও হত্যাকারীর দল। দেশের বাইরেও সরকার বন্ধুশূন্য হয়ে পড়ছে। সব দেশের সঙ্গে সরকার সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলছে। কূটনীতিককে হত্যার পর মধ্যপ্রাচ্য লোকজন ফিরিয়ে দিচ্ছে। মালয়েশিয়ায় একই অবস্থা। বিদেশিরা যাঁরা এসেছেন, তাঁরা বলে গেছেন। কোনো দলের সঙ্গে নয়, এই দেশের জনগণের সঙ্গে তাঁরা সম্পর্ক রাখতে চান। এমনকি ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও একই কথা বলেছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি দাবি করে তিনি বলেন, 'সাগর-রুনিসহ ১৪ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। সরকারের শরিকরাই এখন বলছে, ঘরে থাকলে খুন বাইরে থাকলে গুম। এটি এ সরকারের নীতি। এ থেকে বাঁচতে হলে সরকার পরিবর্তন করতে হবে। আর ভোটের মাধ্যমে সে সরকার পরিবর্তন হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।'
প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যাবাদী মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত মিথ্যা কথা বলেন, সে দেশের উন্নয়ন হবে কিভাবে। এই সমাবেশেও লোক আসতে বাধা দিয়েছে সরকার। তারা ব্যানার ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলেছে। সরকার তাদের সমাবেশে কোকাকোলা-চকোলেট দিয়ে মানুষ আনতে পারে না। টাকা দিয়ে একদিক দিয়ে মানুষ আনে, অন্য দিক দিয়ে ওই সব মানুষ চলে যায়।
সরকারের নেতা-কর্মীদের সরকার মামলা দিয়ে হয়রানি করছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, 'তারা লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হতা করেছে। কিন্তু এখনকার মতো তাদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়নি। অথচ তারা আমাদের ৭০ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। এভাবে মামলা দিয়ে জনগণকে থামানো যাবে না। জনগণের মধ্যে যে আগুন জ্বলছে, তারা কিভাবে বন্ধ করবে?'
ক্ষমতায় এলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার আশ্বাস দিয়ে খালেদা বলেন, 'জিয়াউর রহমান বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছিলেন। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে আমরাও সেটাই করব।' দেশে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিদ্যুৎ দিতে না পারলেও কুইক রেন্টালের নামে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের লোকজন কুইক মানি বানিয়েছে। বিদ্যুৎ এখন যায় না, আসে।
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, 'শেয়ারবাজারসহ জনগণের টাকা লুট করে সরকারি দলের লোকেরা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করছেন। যাঁরা ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েছেন, নির্বাচন কমিশন ও এনবিআরে তাঁদের আয়-ব্যয়ের তথ্য আছে। তিন বছরে তাঁরা কী পরিমাণ দুর্নীতি করলে ৪০০ কোটি টাকা জমা দিয়ে ব্যাংকের অনুমোদন পেতে পারেন। যাঁদের ব্যাংক দেওয়া হয়েছে, প্রত্যেককে পাই পাই হিসাব দিতে হবে। এত সহজে ভবিষ্যতে ছাড়া হবে না। সরকার ব্যাংক ঋণ নিয়ে দেশ চালাচ্ছে। সাড়ে তিন বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই টাকা জনগণ থেকেই উসুল করা হবে।'
দেশে কোনো বিনিয়োগ নেই দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, 'গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির অভাবে নতুন কোনো শিল্প-কারখানা হচ্ছে না। যা আছে, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন। ছয় ঘণ্টা সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখায় পরিবহন ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্ষমতায় গেলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে খালেদা জিয়া বলেন, জনগণের মৌলিক চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে দেশ পরিচালনা করা হবে। যুবসমাজের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। কৃষককে কৃষিপণ্যে ভর্তুকি দেওয়ার পাশাপাশি শিল্প বিকাশে কাজ করা হবে। ভবিষ্যতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহকে দেখে রাখার জন্য স্থানীয় জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
স্থানীয় বিএনপির সভাপতি খলিলুর রহমানের সভাপতিত্বে জনসভায় বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, সহসভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক এম এ মান্নান, শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, কেন্দ্রীয় নেতা হাসান উদ্দিন সরকার, যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়া প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.