মত দ্বিমত বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ে দুর্নীতি দমনের পরিস্থিতির বিষয়ে দুটি লেখা ছাপা হলো।-দুর্নীতি দমনে অগ্রগতি হয়েছে by এ কে আজাদ চৌধুরী

বর্তমান সরকারের সময়ে দুর্নীতি অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। তবে সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন এখনো অনেক দূরে। দুর্নীতি একটা সামাজিক ব্যাধি। এর বহুমাত্রিক ও সর্বগ্রাসী রূপ আমরা নিকট অতীতে দেখেছি। বিশেষ করে বিএনপির গত শাসনামল (২০০১-০৬) এবং পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর।


বিএনপির পাঁচ বছর দুর্নীতির ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল শীর্ষে। পরে সেনাসমর্থিত সরকার দুর্নীতি দমনের নামে ক্ষমতায় এলেও পরবর্তী সময়ে তাদের কেউ কেউ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তাই এ সাত বছর দুর্নীতি দমনে কার্যত অগ্রগতি হয়নি।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, নিরক্ষরতামুক্ত, উদার, অসাম্প্রদায়িক ও দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণ-রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে। তারা প্রথম বছরে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে উন্নতিসাধনের লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, এর অনেকগুলোই এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। এসব পদক্ষেপ সুদূরপ্রসারী ও সময়সাপেক্ষ। তাই কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন এ মুহূর্তে প্রত্যাশা করা ঠিক নয় এবং সরকারের পক্ষে অর্জনও সম্ভব নয়। তবে গত বছরের দুর্নীতির ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ আর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন নয়। আমরা এ কলংক ঘোচাতে পেরেছি।
বর্তমান সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত—এটি কেউ মনে করে না। তবে কার্যপদ্ধতিতে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে গতিশীলতার অভাব কিছুটা পরিলক্ষিত হতে পারে। তা সত্ত্বেও তাদের সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। যেহেতু আমি শিক্ষাঙ্গনের লোক, আমার মনে হয়েছে, নিকট অতীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যে ভয়াবহ দুর্নীতি ছিল, তা থেকে এখন অনেকটাই মুক্ত। অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ হচ্ছে না। তবে একটি ছাত্রসংগঠনের কিছু ক্ষতিকর ব্যক্তির অনৈতিক কর্মকাণ্ড সরকারের ভাবমূর্তিকে অনেকটা ক্ষুণ্ন করছে। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রসংগঠনের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে সরে গেছেন এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনগত ও দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। এর ফলে টেন্ডার, ছিনতাই, অন্তঃকলহ, অনিয়ম কমেছে। তবে এ থেকে পুরো মুক্ত হতে পারেনি।
আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির দায় বেশি, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদের নয়। আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দিয়েছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই তা বাস্তবায়ন করলে অচিরেই এসব দূর হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড়মাপের কোনো দুর্নীতির কথা এখনো শোনা যায়নি। টেন্ডার ড্রপিংয়ের ক্ষেত্রে পেশিশক্তির আধিপত্য কমানোর লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে টেন্ডার প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এটা পুরোপুরি কার্যকর হলে অনেকাংশে এ অনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ হবে।
দুর্নীতি দমনে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি বড় ভূমিকা থাকে। এই ভূমিকা কার্যকর করতে কমিশনটির আইনি কাঠামোর প্রয়োজন হয়। আইন সংশোধন করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও কার্যকর করা সম্ভব। কিন্তু দুর্নীতি দমনের পথে সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে যেসব কার্যক্রম চলেছে তা যথাযথ ছিল বলা যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম দুই-এক মাস বেশ কিছু ভালো পদক্ষেপ নেওয়া হলেও পরে দুর্নীতি দমনের নামে রাজনীতিবিদদের অযথা হয়রানি করা ও তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবেই বিবেচিত হবে। আমরা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চাই, সেই সঙ্গে মানবাধিকারও সমুন্নত রাখতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে কথাটা বলেছেন, তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ দুর্নীতির কোনো অভিযোগ আনতে পারেননি—আমি মনে করি, তা সত্য ভাষণ। এখানে অতিশয়োক্তি নেই। তবে ভবিষ্যত্ দিনগুলোতেও যেন মন্ত্রি ও আমলারা দুর্নীতির অপবাদ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন, সে জন্য সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ আমরা এখনো লক্ষ করিনি। আশা করি, ভবিষ্যতেও তারা হস্তক্ষেপ করবে না। দুর্নীতি বিস্তারের অন্যতম কারণ বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
বিগত সরকারের সময় দুর্নীতির সর্বগ্রাসী রূপ আমরা দেখেছি। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনীতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং ত্রাণের টিনও ক্ষমতাসীনদের লোভের করাল গ্রাস থেকে বাদ পড়েনি। বিদ্যুৎ উত্পাদন ও বিতরণে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়নি। একটি কোম্পানির নাম বহুলভাবে আলোচিত হয়েছিল দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে। সেটা হলো বিদ্যুতের খুঁটি প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে সরকারি ক্ষমতাধরদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। একটি বিশেষ ভবনে চাঁদা না দিয়ে কোনো কাজের চুক্তি হওয়া অসম্ভব ছিল।
দুর্নীতি-সম্পৃক্ত ক্ষমতাধরদের অনেকের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা এমনও দেখেছি, একটি বিশ্ববিদ্যালয় (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) এক দিনে ৫৫৬ জন কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছে নিতান্ত অর্থের বিনিময়ে কিংবা দলীয় বিবেচনায়। আমরা আরও একটি বিশ্ববিদ্যালয় (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়) দেখেছি, যেখানে প্রায় এক হাজার ৫০০ জনের মতো কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও একটি বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি, যেখানে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকের সংখ্যা হাসপাতালে রোগীর শয্যার থেকে বেশি।
বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং দলীয় ভিত্তিতে কর্মকর্তা নিয়োগের প্রতিবেদন সেই সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। দুর্নীতি হয়েছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগেও। এসব রোধে বর্তমান সরকার যথেষ্ট সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে দলীয় নেতা-কর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। এ দেশে প্রচলিত ধারা অনুযায়ী দলীয় নেতা-কর্মীরা প্রত্যাশা করে, তারা চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু বর্তমান সরকারের অবস্থান এর বিপরীত।
এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী বারবার উচ্চারণ করেছেন, কে কী পেলাম না-পেলাম সেদিকে লক্ষ না রেখে দেশসেবা ও জনগণের সেবায় সজাগ থাকুন। তিনি নিজের দলের কর্মীদের সাবধান করেছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন, জোট সরকার তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, হত্যা ও অমানবিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে নিজের ভাগ্য উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে, জনগণের কথা ভাবেনি, আর এ কারণে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, এই পথ অনুসরণ করলে আপনাদেরও ভাগ্য তেমনিভাবে নির্ধারিত হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনের মতে, দুর্নীতি অনেক কমেছে, ধারণাসূচকে আমাদের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে। তবে এতে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই, আমাদের আরও সামনে এগোতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ দুর্নীতিপরায়ণ নয়। কিন্তু মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ক্ষমতায় থেকে আমাদের চরিত্র কলংকিত করেছে। তাদের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারলে আমরা বাংলাদেশকে অচিরেই একটি দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিরক্ষরতা এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে বিশ্বসমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারব।
ড. এ কে আজাদ চৌধুরী: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.