আফগানিস্তান-আমি ক্রুদ্ধ কিন্তু হতাশ নই by মালালাই জয়া

গত জানুয়ারিতে লন্ডনে তালেবানদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য সম্মেলন হয়ে গেল। সেখানে কারজাই সরকারকে লাখ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হলো। কেন? কারণ, ওই টাকা দিয়ে তিনি বিদ্রোহীদের অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি করাবেন। আর সেই সময়ই লাখ লাখ আফগান দারিদ্র্যের কারণে মারা যাচ্ছে।


ওই অর্থ দিয়ে তালেবানদের পুনর্বাসন করা হবে। তারা আফগান পার্লামেন্ট লয়া জিরগার নিয়ন্ত্রণ নেবে। দেশের মুরব্বিদের সঙ্গে এ লক্ষ্যে গোত্রীয় পরিষদের বৈঠকও শিগগিরই হতে যাচ্ছে। এসব প্রতিক্রিয়াশীলের হাত দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো আশা কি আসলেই আমরা করতে পারি?
তালেবানরাই একমাত্র মৌলবাদী নয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের শিষ্য-সাগরেদরা মোল্লা ওমরের শাসনকে উচ্ছেদ করে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সসহ অন্যান্য যুদ্ধবাজের হাতে দেশের ভার তুলে দিয়েছে। এদের চিন্তাধারা তালেবানদের থেকে খুব একটা আলাদা নয়। গত কয়েক বছরে এদের হাতে কেলেঙ্কারিজনক আইন ও বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত পাস হয়েছে। জাতীয় সমঝোতার নাম করে যুদ্ধবাজ ও যুদ্ধাপরাধীদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। আজ তাদের অনেকেই সংসদে বসছে। সবগুলো উঁচু পদ তাদের দখলে: তারা সংসদে আছে, তারা মন্ত্রী হয়েছে, তারা বিচার বিভাগে রয়েছে এবং এদের সবাইই মহাদুর্নীতিবাজ। আর এখন জাতিসংঘ তাদের কালো তালিকা থেকে সাবেক তালেবান নেতাদের নামও বাদ দিচ্ছে। এভাবে কি জনগণের ভবিষ্যত্ নিরাপদ হয়? প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই কিছুদিন আগে কাবুলের কাছে কোকা-কোলা কারখানা উদ্বোধন করেছেন। একদিকে যুদ্ধাপরাধী, দুর্নীতিবাজ ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা; অন্যদিকে কোকা-কোলা—এই হলো পশ্চিমাদের আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নমুনা।
এসব কিছুর বিরোধিতা করার জন্যই আমি আফগান পার্লামেন্ট থেকে বহিষ্কৃত হই। পার্লামেন্ট অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনে আমি ‘আফগান জনগণের প্রতি আমার শোক’ জ্ঞাপন করি। অনেক সদস্যই এতে আমার ওপর রুষ্ট হন। তাঁরা অভিযোগ করেন, এতে নাকি তাঁরা আক্রান্ত বোধ করেছেন। আসলে যুদ্ধবাজ নেতারা চেয়েছিল, আমি যাতে পার্লামেন্টে না থাকি। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালজুড়ে চলা গৃহযুদ্ধের সময় এরাই কাবুল শহর লুণ্ঠন করেছে, হাজার হাজার নিরীহ মানুষের রক্ত লেগে আছে এদের হাতে। আমি পার্লামেন্টে এটাও বলি যে আন্তর্জাতিক আদালতে এদের বিচার হওয়া উচিত। আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধেও বলি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফ থেকে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের নামে কোটি কোটি ডলার দেওয়া হয়। সব চলে যায় এসব যুদ্ধাপরাধীর হাতে। স্বাভাবিকভাবেই এসব কিছুর বিরোধিতা করায় আমি টিকতে পারলাম না। আমি পার্লামেন্টে কথা বলতে শুরু করা মাত্রই তারা আমার মাইক্রোফোন বন্ধ করে দিতে থাকল। এতে গলার সমস্ত জোর দিয়ে আমাকে চিত্কার করতে হলো। অপমান আর হুমকির মুখেও আমি সোচ্চার থাকলাম। সদস্যদের কয়েকজন আমার পক্ষে দাঁড়ালেন। কিন্তু তাঁরা ছিলেন খুবই অল্প। আমাকে বলা হলো নাস্তিক, বলা হলো কমিউনিস্ট। সম্ভব সব রকম অপমান আমাকে করা হলো। টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে আমি পার্লামেন্টকে চিড়িয়াখানার সঙ্গে তুলনা করি। আসলেই আফগান পার্লামেন্ট আস্তাবলের থেকেও খারাপ, কারণ পশুদেরও কিছু দেওয়ার থাকে।
গণতন্ত্র বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কিংবা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে নির্মূলের উদ্দেশ্যে আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালিত হয়নি। এর আসল উদ্দেশ্য হলো স্থায়ী দখলদারিত্ব কায়েম রাখা, সেনা ঘাঁটি স্থাপন করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ একটি অঞ্চলকে অধিকার করে রাখা। ওবামা বুশের থেকে মন্দ না হলেও ভাল কেউ নন। তিনি বুশের আমলের থেকে যুদ্ধকে আরও প্রসারিত করছেন এবং পাকিস্তানকেও আক্রমণের নিশানায় ফেলেছেন। মার্কিন সরকার ইচ্ছা করে এ অঞ্চলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখছে, যাতে তাদের উপস্থিতির অসিলা তৈরি থাকে। এর মাধ্যমে আফগানিস্তানে বসে তারা প্রতিবেশী ইরান, পাকিস্তান, রাশিয়া ও উজবেকিস্তানের ওপর নজরদারি চালাতে পারছে। ওবামা যদি তাঁর সেনাবাহিনী সরিয়ে না নেন, তাহলে আরও রক্তপাত, আরও বিপর্যয় হবে।
জাতিসংঘের বোমাবর্ষণের দিকে খেয়াল করুন। ২০০৯ সালের মে মাসে আমার প্রদেশেই ১৫০ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। এই গণহত্যা বিশ্ববাসীকে একটা জানালা খুলে দিয়েছে দেখার জন্য যে আফগানিস্তানে কী ঘটছে। কিন্তু আসলেই কি বিশ্ববাসী দেখতে চায়? আমি একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম। জেরানির এক গ্রামবাসী সেখানে বলেছিল, কীভাবে তার পরিবারের ২০ জন গণহত্যার শিকার হয়েছে। এখন এ ধরনের তরুণেরা কি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তালেবানদের দলে যোগ দেবে না? যতই হোক না কেন তারা মৌলবাদী?
পশ্চিমারা আফগান নারীদের মুক্তি দেবে বলে যুদ্ধ শুরু করেছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বাস্তবতা ভিন্ন। আফগান সংবিধানে নারীর অধিকার নিয়ে কিছু কথা আছে। কিন্তু মৌলবাদীদের শক্তিমত্তার চাপে এগুলোর কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। আজ কারজাই সরকার আর পশ্চিমা শক্তি এদের সঙ্গেই গাটছড়া বেঁধে আছে। আজও দেশ চলে শরিয়া আইনে। সংবিধানে গণতন্ত্রের যা কিছু কথা বলা আছে, তা শুধু পাশ্চাত্য দেশগুলো থেকে সাহায্য পাওয়া এবং তা লুটেপুটে খাওয়ার জন্য। আজ আফগানিস্তান এমন এক দেশ, যেখানে ১৪-১৫ বছরের যেসব মেয়ে শ্বশুরবাড়ির চরম সহিংসতা থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসছে, তাদের বলা হচ্ছে অপরাধী। বিচারে তাদের শাস্তি হচ্ছে। হ্যাঁ, আগের চেয়ে বেশি হারে মেয়েরা বিদ্যালয়ে পড়তে আসছে, কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, বেশি হারে মেয়েরা বিদ্যালয় ছেড়েও যাচ্ছে। কেননা, তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং পরিবার থেকে তাদের জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মরিয়া হয়ে অনেক তরুণী আত্মহত্যা করছে। এসব মেয়ে জানে যে জীবন আরও অন্যরকম হতে পারে। কিন্তু সেই সুযোগ তাদের সামনে খোলা নেই।
আজ আফগানিস্তানের জন্য একমাত্র পথ হলো সমস্ত বিদেশি সেনা প্রত্যাহার এবং স্থানীয় যুদ্ধবাজদের অপসারণ। দখলদারদের হাতে কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। তারা আমার দেশের তালেবানীকরণ বরং আরও বাড়িয়েছে। এসবের খেসারত দিতে হচ্ছে আমার জনগণকে।
যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতিসংঘের সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে না গেলে তারা আফগানদের পক্ষ থেকে আরও শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়বে। পশ্চিমা সরকারগুলো ক্রমাগত অস্বীকার করে আসছে যে মানুষ তাদের দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াই করতে মরিয়া। আর তারা তা করতে চায় সব নারী ও পুরুষের প্রতি সম্মানজনক শর্তে। আজ আফগানিস্তানের সংবিধান অনুসারে ধর্মভিত্তিক দল ছাড়া আর কারও রাজনীতি করার অধিকার নেই। অথচ গত কয়েক মাসে বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে কাবুলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও নারী মিছিল করেছে। এসব মিছিলই দুনিয়াকে আফগানিস্তানে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ দেখাচ্ছে। আমাদের জনগণের মধ্যে অনেক বীর নারী ও পুরুষ রয়েছেন। তাঁরা তাঁদের গ্রাম ও শহরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
কী কারণে কোনো পশ্চিমা নেতা আফগানিস্তানের এই প্রগতিশীল শক্তিকে স্বীকার করেন না? কেন কোনো রকম সহযোগিতা তাঁরা পান না? আমি এখনো আশা হারাইনি। আমাদের পশ্চিমা জনমতের সমর্থন দরকার। আমার সফরগুলোতে ধীরে ধীরে সেই সমর্থন জাগতে দেখছি। আফগানিস্তানে নতুন করে সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। পশ্চিমের অনেক মানুষ আর ‘ন্যায়ের যুদ্ধ’ নামক তত্ত্বে বিশ্বাস করে না। কিন্তু যুদ্ধের নেশায় মাতোয়ারা সরকারগুলোকে থামাতে হলে আরও বেশি প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন।

লা হিউমানাইট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে ভাষান্তর ফারুক ওয়াসিফ
মালালাই জয়া: আফগান পার্লামেন্ট থেকে বহিষ্কৃত জনপ্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.