চারদিক-ইতিহাস সংরক্ষণ করতে হলে by শিখ্তী সানী

ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫। বাংলাদেশে ডাচ দূতাবাসে কর্মরত বন্ধুর অনুরোধে ফ্লুরাস জেরাল্ডস প্রথমে আসেন ঢাকায়। প্লেনের ছোট্ট জানালা দিয়ে তাঁর কাছে ধরা দেয় বাংলাদেশের অসম্ভব সুন্দর সবুজ প্রকৃতি। বিমানবন্দরে হাজার হাজার অপেক্ষারত মানুষ, বিদেশ থেকে আসা কর্মজীবী মানুষের ভিড়,


দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের সহযোগিতা ও আতিথেয়তা এ দেশের প্রতি এক অদ্ভুত বন্ধন তৈরি করে দিয়েছে। সেই ১৯৯৫ সাল থেকে আজ অবধি ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে আসছেন ফ্লুরাস। একজন নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন দেশের আর্কাইভ ও রেকর্ড ব্যবস্থাপনায়। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা ঘুরে তিনি দেখেছেন দেশের ইতিহাস, পুরোনো তথ্যাদি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ছবি, পাণ্ডুলিপি, স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিষয়ক উপাদানকে আমরা কীভাবে সংরক্ষণ করে রেখেছি। পর্যবেক্ষণ করেছেন দেশের আর্কাইভ সমৃদ্ধিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগকে। দেশের আর্কাইভ সংরক্ষণ ও সংগ্রহে ত্রুটিগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের পথ দেখিয়েছেন। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে আর্কাইভ ও রেকর্ড ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছেন।
ফ্লুরাস জেরাল্ডসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নেদারল্যান্ডে। ১৯৭১ সাল থেকে একজন আর্কিভিস্ট ও ইতিহাসবিদ হিসেবে কাজ করছেন। নেদারল্যান্ডের একজন সরকারি আর্কিভিস্টের পাশাপাশি ডাচ প্রাদেশিক প্রতিষ্ঠান আশা (অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ হল্যান্ড আর্কিভিস্ট)-এ কাজ করছেন। বাংলাদেশকে ঘিরে কাজ শুরু করেছিলেন ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণেই। বর্তমানে আশা বার্ম (বিএআরএম বাংলাদেশ আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড ম্যানেজমেন্ট সোসাইটি)-এর সঙ্গে কাজ করছেন।
ফ্লুরাস মনে করেন, একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো সে দেশের আর্কাইভ সংরক্ষণ। কোনো দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা তাদের সংগ্রহশালা থেকে বুঝতে পারা যায়। শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গঠনগত তাৎপর্য তাদের আর্কাইভ সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। কোনো সমস্যাকে চিহ্নিতকরণ, তার সমাধান, নতুন প্রচেষ্টা গ্রহণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন সেই প্রতিষ্ঠানের আর্কাইভের সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ প্রকৃতভাবে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত নয়। তাই আমাদের জন্য আর্কাইভ সংরক্ষণ আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। আধুনিক বিশ্বে মানুষের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রথমেই তথ্যের জোগান, সংরক্ষণ ও তথ্যে সবার অবাধ প্রবেশাধিকার প্রয়োজন, যা বাস্তবায়ন করার জন্য আর্কাইভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তা ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিকাংশ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র রোগীদের তথ্যাদি সংগ্রহ করে রাখে না। অথচ চিকিৎসক তাঁর রোগীদের সম্পর্কে জানবে, তাঁর এলাকার সামগ্রিক স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে জানবে—এটাই তো হওয়া উচিত। তা না হলে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ব্যাহত হবে।
দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্কাইভ সংরক্ষণ তেমনভাবে না গড়ে ওঠার আরেকটি কারণ হিসেবে ফ্লুরাস মনে করেন, মানুষ জানে না কীভাবে আর্কাইভ কিংবা তথ্য সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। তাদের জন্য নেই কোনো প্রশিক্ষণ। ফ্লুরাসের প্রথম বাংলাদেশ সফরে ঘটনাক্রমে তাঁর একটি ক্যামেরা হারিয়ে যায়। বিমা আছে, এমন কাগজপত্রের জন্য তিনি ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানার পুলিশের কাছে সহযোগিতা চান। সেখানে তিনি বুঝতে পারেন, অনেকেই তথ্য সংরক্ষণের কোনো নিয়ম জানেন না। সঠিক তথ্য সংরক্ষণের অভাবে সেখানে নানা অব্যবস্থাপনা ও জটিলতা আছে।
১৯৯৫ সাল থেকে ফ্লুরাস বাংলাদেশের আর্কাইভ সংরক্ষণকে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। সে সূত্রেই দেখা হয়েছে দেশের নানা প্রান্তে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশীয় ইতিহাস ও স্থানীয় সংস্কৃতির উপাদান সংরক্ষণকে। কথা বলেছেন দেশের ইতিহাসবিদ, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভ, জেলা পর্যায়ের রেকর্ড রুম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগ্রহ দেখেছেন। দীর্ঘ সময়ে তাদের প্রচেষ্টা, পরিবর্তন ও উন্নতির ধাপগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন। ফ্লুরাস মনে করেন, বাংলাদেশ অতীতের তুলনায় অনেক সচেষ্ট হয়েছে। তথ্য সংরক্ষণে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্ব বেড়েছে। তবে বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভের আরও মানসম্পন্ন পরিবর্তন দরকার। উন্নত দেশগুলোতে সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আর্কাইভের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেদিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের জাতীয় আর্কাইভে রাষ্ট্রীয় দলিলপত্র সংরক্ষণের মান মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক সুশাসিত দেশ হিসেবে আখ্যা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে তার জাতীয় আর্কাইভের সংস্কার নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের এখানে আর্কাইভ পরিচালনা ও সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় জনবল নেই। যে অল্পসংখ্যক লোক নিয়োজিত আছেন, তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই, আর্কাইভ সংরক্ষণে জ্ঞানও সীমিত। সংরক্ষিত সম্পদগুলো স্থানসংকুলান ও সঠিক পরিচালনার অভাবে অব্যবস্থায় পড়ে আছে। সরকারিভাবে জাতীয় আর্কাইভের প্রতি ব্যয় সীমিত হওয়ার দরুন আমরা অনেক তথ্যাদি হারিয়ে ফেলছি। ফ্লুরাস বলেন, আর্কাইভ সংরক্ষণে আরও মনোযোগী হওয়া দরকার। সরকারি পর্যায়ে জাতীয় আর্কাইভ সংস্কারের জন্য জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বৃদ্ধি করতে হবে সরকারি ব্যয়, জনবল ও প্রয়োজনীয় স্থান ও উপকরণ। দেশের ইতিহাসবিদ, ব্যক্তিগত ও দলগত উদ্যোগে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের একত্রে কাজ করতে হবে। আর্কাইভ নির্মাণে মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আর্কাইভ সংরক্ষণ নিয়ে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ফ্লুরাস জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের তথ্য অধিকার আইন ও ‘পাবলিক রেকর্ড অ্যাক্ট’ প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। এর মধ্য দিয়েই মানুষের তথ্যের প্রয়োজনীয়তা ও সংরক্ষণের চাহিদা গড়ে উঠবে। তথ্যে প্রবেশাধিকার মানুষকে সচেতন করবে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার ইতি টানবে।
দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে অবস্থানকালে ফ্লুরাস দেখেছেন গণতন্ত্রের নানা চড়াই-উতরাই। সরকার বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আমাদের জাতীয় ইতিহাস। এর কারণ হিসেবে ফ্লুরাস চিহ্নিত করেন আমাদের ইতিহাস এবং আর্কাইভ সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতা। সঠিক সংরক্ষণের অভাবে শূন্যস্থানগুলোতে নানা ভ্রান্তিমূলক তথ্য এসে হাজির হয়। তাই সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে জনগণের জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য, দেশের আর্কাইভ ও রেকর্ড ব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধির জন্য। ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের উৎসাহ দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.