পাশ্চাত্য সুর প্রভাবান্বিত রবীন্দ্রসংগীত by তপন মাহমুদ

ইংরেজি বা ইউরোপীয় গানের সুর ভেঙে যেসব গান রচনা হয়েছে বলে স্বীকৃত, সেসব গানের বাইরে পাশ্চাত্য সুরের প্রভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রবীন্দ্রসংগীত রচিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পূজা, প্রেম ও বিচিত্র পর্যায়ের বেশ কিছু গান।
প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য সংগীতের মধ্যে যে ভিন্নতা সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে, তাহলো প্রাচ্য সংগীতের মেলোডি এবং


অন্যদিকে পাশ্চাত্য তথা ইউরোপীয় সংগীতের হারমোনি-নির্ভরতা। প্রাচ্য তথা উপমহাদেশীয় সংগীতে পরিবেশনরত শিল্পী একটা সুনির্দিষ্ট মেলোডির মধ্যে নিজের ইচ্ছামতো সুরের ফসল বুনে চলেন। কিন্তু পাশ্চাত্য সংগীতে শিল্পী হলেন সুরকারের যন্ত্রবিশেষ। শিল্পীর সুর বিহারের কোনো অবকাশ সেখানে নেই। রবীন্দ্রনাথ কেবল প্রচলিত দেশীয় সুরের কাঠামোর আবেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চাননি। তাই যখনই তিনি সেই আবেষ্টনী ভেঙে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়েছেন, তখনই পূর্ব-পশ্চিমের সীমারেখা নিমেষে বিলীন হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে 'সংগীত চিন্তা' গ্রন্থের 'সংগীত' প্রবন্ধে তিনি বলেছেন_
'আমাদের শিল্পকলায় সম্প্রতি যে উদ্বোধন দেখা যাইতেছে তাহার মূলেও য়ুরোপের প্রাণশক্তির আঘাত রহিয়াছে। আমার বিশ্বাস, আমাদের সংগীতেও বাহিরের সংস্রব প্রয়োজন হইয়াছে। তাহাকে প্রাচীন দপ্তরের লোহার সিন্দুক হইতে মুক্ত করিয়া বিশ্বের হাটে ভাঙাইতে হইবে। য়ুরোপের সংগীতের সঙ্গে ভালো করিয়া পরিচয় হইলে তবেই আমাদের সংগীতকে আমরা সত্য করিয়া, বড়ো করিয়া ব্যবহার করিতে শিখিব।'
প্রথম যৌবনে রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন সতেরো তখনই ইউরোপীয় সংগীতের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়। সে সময়ে 'বাল্মীকি প্রতিভা' এবং কালমৃগয়ার গান থেকে আরম্ভ করে এর পরে অজস্র রচনায় ইউরোপীয় সংগীতের রস নানাভাবে প্রধানত রবীন্দ্রসংগীতকে অবলম্বন করে দেশীয় সংগীতের আঙ্গিকে এবং প্রকাশভঙ্গির মধ্যে অনায়াসে অবলীলায় সঞ্চারিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি গান এখানে উল্লেখ করা যায়, যেমন_'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে', 'আজি শুভদিনে পিতার ভবনে', আমরা নূতন যৌবনেরই দূত', 'তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা', 'প্রাণ চায় চক্ষু না চায়' ইত্যাদি। এসব গানে ভারতীয় সংগীতের মেজাজটি অক্ষুণ্ন থাকলেও সুরের গঠনে ও তালের চলনে অন্য একটা আমেজও যেন লেগেছে।
রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের মোট ৬১৭টি গানের মধ্যে দুইশতেরও বেশি গান দেশীয় রাগসংগীতের প্রভাবে রচিত এবং এসব গান তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়সের আগে লেখা। পঞ্চাশোর্ধ বয়সে রচিত তাঁর গানে ধ্রুপদ বা দেশীয় প্রচলিত গানের সুর ও তালের সুস্পষ্ট অনুসরণ বা প্রয়োগ অনেক কম। এ সময়ে তিনি গানের সুরের মধ্যে রাগরাগিণীর যেমন অবাধ মিশ্রণ শুরু করেছিলেন, তেমনি তালেও চৌতাল, ধামার পেরিয়ে ত্রিতাল-একতালের দীর্ঘ আবর্তনগুলোকে চতুর্মাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ছন্দে নতুন গতিচাঞ্চল্যের আন্দোলনে স্পন্দিত করেছেন। তাঁর পঞ্চাশ থেকে আশি বছর বয়সে রচিত পূজার গানের সুরে এক বিশেষ ধরনের গতিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। এসব গানে পাশ্চাত্য সংগীতের ঢঙে স্বচ্ছন্দে কর্ড প্রয়োগ করা চলে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে হারমোনিতত্ত্ব। এ ধরনের কয়েকটি গান হলো চতুর্মাত্রিক ছন্দে 'সুন্দর বটে তব অঙ্গদুখানি', 'তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী', 'নয় নয় এ মধুর খেলা', 'আমার সকল রসের ধারা' এবং ত্রিমাত্রিক ছন্দে 'এ মণিহার আমায় নাহি বাজে', 'এবার আমায় ডাকলে দূরে', 'তাই তোমার আনন্দ আমার পর' ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের মোট ৩৯৫টি প্রেমের গানের মধ্যে ৪০-৫০টি ছাড়া অন্য প্রায় সব গানে সুর ও তালের ছোট ছোট পদবিন্যাস করে, তালবিভাগের সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি ছোট ছোট পদ গঠন করেছেন, যার ফলে কর্ড নির্মাণ ও কাউন্টার পয়েন্টের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে কিছু গানে আবার পাশ্চাত্য সংগীতের সরাসরি অনুসরণ করা হয়েছে যেমন_'আমি চিনি গো চিনি তোমারে', 'বলি ও আমার গোলাপবালা', 'তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা' ইত্যাদি। এসব গানে পাশ্চাত্য সংগীতের ভাব যত প্রবল, দেশীয় সংগীতের ভাবটি তত স্পষ্ট নয়। এর বিপরীতে পাশ্চাত্য সংগীতের নির্যাস গ্রহণ করে আপন প্রতিভার স্পর্শে উদ্ভাসিত রবীন্দ্রনাথের বহু প্রেমের গান রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যায়। যেমন_'তুমি রবে নীরবে', 'সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে', 'মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে', 'আমার পরান যাহা চায়', সে দিন দুজনে দুলেছিনু বনে', 'বিরহ মধুর হলো আজি', 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ' ইত্যাদি।
এভাবে প্রেম পর্যায়ের প্রায় সাড়ে তিন শ গানের নাম এখানে অন্তর্ভুক্ত করা যায় অনায়াসে। এ ধরনের আরো অনেক গান রয়েছে বিচিত্র পর্যায়ে। যেমন_'তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা', 'আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসী' ইত্যাদি। ইউরোপীয় সংগীত থেকে এক সময় যে রস রবীন্দ্রনাথ আহরণ করেছিলেন, এসব গানের ভেতর দিয়ে তা অনায়াসে অবলীলায় তাঁর সংগীতে সঞ্চারিত করেছেন, সৃষ্টি হয়েছে এক ভিন্ন স্বাদ এবং রসবৈচিত্র্যে ভরপুর সংগীতে।

No comments

Powered by Blogger.