দূরের দূরবীনে-তবুও তিনি দীপ্র, উজ্জ্বল ও পথের দিশারি by অজয় দাশগুপ্ত

তারুণ্যের ভেতর রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অনেকে বলেন, বর্তমান প্রজন্ম তাঁকে পাঠ করে না। তাঁর গান শোনে না, তাঁর কবিতাও তাদের টানে না। হতেই পারে। আমি বলি, তাতে ক্ষতি কী? রবীন্দ্রনাথ কি নিমপাতা, না চিরতার জল যে নিত্যদিন রুটিন করে গিলতে হবে? নাকি বাধ্যতামূলক?


একবার যদি কেউ বঙ্গে জন্মে, বাঙালি হয়ে বাঁচে অথবা মরতে চায়, তার ঠিকানা রবীন্দ্রনাথ, আজ যারা বয়সের ঝোঁকে চটজলদি মিডিয়া বা ধুন্দুমার জনপ্রিয়তার কারণে তাঁকে মনে ঠাঁই দিচ্ছে না, পরিণত বয়সে এরাই হবে তাঁর সর্বাপেক্ষা পাগল অনুসারী, রবীন্দ্রনাথের প্রতি পক্ষপাত বা অণুত্বের কারণে নয়, এ কথা বলছি তাঁর মিলন ও সাধনার উজ্জ্বলতা বিচারে। দেশ পত্রিকার দুঁদে সম্পাদক সন্তোষ কুমার ঘোষের সেই গল্পটির মতো। যৌবনে কোনো সন্তানই তার পিতাকে নিজের চেয়ে আধুনিক বা অগ্রসর মনে করে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সর্বদাই ভাবে এবং খুঁজতে থাকে কোথায় কোথায় সে স্বতন্ত্র। আত্মতৃপ্ত হয়ে ওঠে, না! আমি পুরোটাই আমার মতো। দিন যায়, বয়সও বাড়ে। প্রৌঢ়ত্বে পেঁৗছে সে সন্তানই পুরনো দেরাজ খুলে হয়তো পেয়ে যায় পিতার যৌবনের অথবা শেষ বিকেলের ধূসর হয়ে আসা ছবি, মন বিপন্ন করা বিকেলে অথবা উদাস সন্ধ্যায় তখন তার চিন্তাটা অন্য রকম। খালি মিলাতে চায়, কোথায় কোথায় সামঞ্জস্য, কতটুকু পিতার মতো_এই হিসাবের অঙ্কই তখন পাগল করে তোলে। তিরিশের অবাধ্য কবিকুল থেকে হাল জমানার প্রথাবিরোধী অথবা ঘোর মার্কসিস্ট লেখক_সবাই শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথে সমর্থিত। তাঁর সঙ্গে তাঁর সৃষ্টি বা উজ্জ্বলতার সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল খুঁজে পেতে মরিয়া অথবা অধীর। ফলে তাঁর সঙ্গে জীবনের একপর্যায়ে আত্মার বন্ধন ঘটবেই। শুধু কি কবি আর গীতিকার বলে? আরো কত অজানা অধ্যায়ে এই মানুষটি আমাদের অতি আপন।
বাঙালির জীবনে দরিদ্রতার পর সবচেয়ে সুলভ বস্তু অপমান। নিজেদের অপমান করায় এত সিদ্ধ জাতি দুনিয়ায় বিরল। খ্যাতির আগুন রবীন্দ্রনাথকেও ছেড়ে কথা বলেনি। তাঁর বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেক খ্যাতিমান বাঙালি নিজেদের সবিশেষ ক্ষতি করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এঁদের একজন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯১২ সালে ডি এল রায়ের ব্যঙ্গ নাটক 'আনন্দ-বিদায়' সে ধরনেরই এক কাণ্ড। সে নাটক দর্শক রোষে পুরোটা দেখতে পারেননি তিনি। নাটকটি বিলেত ঘুরে এসে পিডি ডিগ্রি অথবা পুরস্কার পাওয়ার তির্যক খোঁচা নিয়ে লিখিত। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস_পরের বছর রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির আগেই মারা যান ডি এল রায়। অথচ ডি এল রায়ের জীবনীগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের লেখার অংশ এ রকম_'দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে আমার যে পরিচয় স্মরণ করিয়া রাখিবার যোগ্য তাহা এই যে আমি অন্তরের সহিত তাহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি। আমার লেখায় বা আচরণে কখনো তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করি নাই।_আর যাহা কিছু অঘটন ঘটিয়াছে তাহা মায়া মাত্র।'
এই হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। জীবদ্দশায় অপমানে, কশাঘাতে জর্জরিত, একের পর এক প্রিয়জন হারানোয় মুহ্যমান। তবু টলেননি। ওই যে বলছিলাম, আমাদের স্বভাবই হচ্ছে অপমান করা, তিলকে তাল বানানো। ভারতের জাতীয় সংগীত যেটি ব্রাহ্মসংগীত রূপে লিখিত, তা নিয়েও কি কম হৈচৈ। রাষ্ট্র করা হয়েছিল তাঁর এ গান সম্রাট পঞ্চম জর্জের দিলি্ল দরবার উপলক্ষে রচিত, তা-ও রাজকর্মচারীর অনুরোধে। অথচ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অনুরোধের বিস্ময় এবং পরবর্তীকালে সঞ্চিত উত্তাপের ধাক্কায়ই এ গানটির জন্ম। তিনি লিখেছেন : আমি জনগণমন অধিনায়ক গানে সেই ভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় যুগ যুগ ধাবিত যাত্রীদের যিনি সারথি, সে রথ চালক পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারে না।'
আরো আছে, এক-জাতীয় সাম্প্রদায়িক মানুষের চিরশত্রু রবীন্দ্রনাথ। তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা, রবীন্দ্রনাথ যা-ই করুন না কেন, মুসলমানদের জন্য কিছু করেননি। তাঁরা জানেন না রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আগে তাঁদের বলা হতো পীরালি ব্রাহ্মণ। সারা জীবন অসাম্প্রদায়িকতার পতাকা বয়ে যাওয়ার ভিত্তিটা পরখ করলেই হয়। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের লেখা হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী গাওয়া হতো বুদ্ধের জন্মদিনে। যিশুর জন্মদিনে 'একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে' ও গুরু নানকের জন্মদিনে 'গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে'। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিনে মন্দিরের অনুষ্ঠানে 'কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো' গানটি গাওয়ার রেওয়াজ ছিল। এ তো উৎসবের কথা। ইসলাম প্রবক্তা নবীজি বিষয়ে তাঁর কি আদৌ কোনো রচনা নেই? তাঁর ব্রাহ্মসমাজের ভাই গিরিশচন্দ্র সেন প্রথম বংলায় কোরআন অনুবাদ করলেন। রবীন্দ্র-ঘনিষ্ঠ শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক প্রমদারঞ্জন ঘোষ ছিলেন পয়গম্বর ভক্ত। কবির সন্তানতুল্য স্নেহভাজন সন্তোষ মজুমদারও লিখেছেন নবীজিবিষয়ক রচনা। রবীন্দ্রনাথ কি কিছুই লিখেননি? রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিতাভ চৌধুরীর মতে, 'রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত কিছু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তার কারণ, লেখার কোথাও কোনো প্রকার স্খলন ঘটলে মুসলমান সমাজ তাঁকে ক্ষমা করত না।' তবু তিনটি ক্ষেত্রে তিনি তাঁর মনের কথা জানিয়েছেন।
সিরাতুন নবী বা পয়গম্বর দিবস উপলক্ষে ১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন বোম্বে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় রবীন্দ্রনাথ প্রেরিত বাণীটি পাঠ করেন বিখ্যাত নেত্রী শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু। বাণীটি এই : 'জগতে যে সামান্য কয়েকটি মহান ধর্ম আছে, ইসলাম ধর্ম তাদেরই অন্যতম। মহান এই ধর্মমতের অনুগামীদের দায়িত্বও তাই বিপুল। ইসলামপন্থীদের মনে রাখা দরকার, ধর্মবিশ্বাসের মহত্ত্ব আর গভীরতা যেন তাঁদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ওপর ছাপ রেখে যায়। এই দুর্ভাগা দেশের অধিবাসী দুটি সম্প্রদায়ের বোঝাপড়া শুধু তো জাতীয় স্বার্থের সপ্রতিভ উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে না : সত্যদ্রষ্টাদের বাণী নিঃসৃত শাশ্বত প্রেরণার ওপরও তার নির্ভরতা।'
১৯৩৪ সালে একই দিবসে বেতারে প্রদত্ত বাণীতে তিনি বলেন, 'ইসলাম পৃথিবীর মহত্তম ধর্মের একটি।' জীবনের নানা স্তরে, জমিদারি রক্ষা থেকে শান্তিনিকেতনের পরিবেশ, মুসলমান ছাত্রদের পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া_সর্বব্যাপী উদারতায় এটা প্রমাণিত যে তিনি ছিলেন ঘোর অসাম্প্রদায়িক। তবু হেনস্তা বা অপবাদ নেই যা তাঁর কপালে জোটেনি। আজও সে জের সমানে চলছে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি হয়ে জন্মেছিলেন, সে তো বাঙালির ভাগ্য। তাঁর মৃত্যুযাত্রা এমনকি শেষ বিদায়ও বাঙালি কুসুমাস্তীর্ণ রাখতে পারেনি। তাঁর ইচ্ছা ছিল শোকমিছিলে যেন উদ্দামতা না থাকে, জয়ধ্বনি দেওয়া না হয়, না থাকে কোনো মাতম। অথচ তাঁর মৃত্যুর পর কী ঘটেছিল? একমাত্র জীবিত পুত্র রথীন্দ্রনাথ শোকে দিশেহারা। প্রশান্ত মহলানবিশ জ্বরে শয্যাশায়ী, চিকিৎসকরা যার যার বাড়িতে। প্রচণ্ড ভিড়ে উদ্দাম বাঙালির কাঁধে কাঁধে শেষ যাত্রায় যেত হয়েছিল তাঁকে, প্রথামতো মুখাগি্নও করতে পারেননি রথীন্দ্রনাথ। কোনো এক দূর সম্পর্কের নাতি যখন তা করে তখন স্মৃতি হিসেবে মাথার চুল, মুখের দাড়িও প্রায় উপড়ে নিয়ে গেছে বিশৃঙ্খল জনতা। এত বড় দায়িত্বহীনতা, অসুন্দরের হাতে সুন্দরের চির পূজারি কবিকে ছেড়ে দেওয়াই ছিল বাঙালির কাজ। তবু তিনি দীপ্র, উজ্জ্বল, আলোকমালার মতো পথের দিশারি, নিত্যনতুন হয়ে ফিরে আসেন।
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.