শেকড়ের ডাক-স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্গতি ও আসন্ন চ্যালেঞ্জ by ফরহাদ মাহমুদ

পত্রপত্রিকায় দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে চিত্র পাওয়া যায়, তা প্রত্যাশিত নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তদুপরি যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা অধিকাংশ সময়ই সেখানে থাকেন না।


হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনাও চূড়ান্ত পর্যায়ে। উপজেলা তো বটেই, জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর অবস্থাও এমন যে নাকে রুমাল দিয়েও সেখানে ঢোকা কষ্টকর। রোগ নির্ণয় বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। অথচ এই হাসপাতালগুলোই গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একমাত্র ভরসা। তারাই দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি। সেদিক থেকে বলা চলে, 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে' অর্জিত বাংলাদেশে স্বাধীনতার চার দশক পরও অধিকাংশ মানুষ একরকম বিনা চিকিৎসায়ই মৃত্যুকে বরণ করে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে মহাজোটের নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি দেখে আমরা অনেক বেশি আশ্বস্ত হয়েছিলাম। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে আমরা দেশের স্বনামখ্যাত একজন চিকিৎসককে পেয়েও খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তব যে কঠিন_সেই সত্যটি আমরা বরাবরই ভুলে যাই। ফলে বরাবরই আমাদের হোঁচট খেতে হয়। মহাজোট সরকারের আড়াই বছরের স্বাস্থ্যচিত্র দেখেও আমরা একইভাবে হোঁচট খেয়েছি। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কর্মকাণ্ড আমাদের শুধু হতাশ করেনি, অবাকও করেছে। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে সুপারিশ করা আর স্বাচিপ নেতাদের তুষ্ট করাটাই যেন তাঁর প্রধান কাজ। কিন্তু আমরা যে তাঁর মতো একজন প্রবীণ চিকিৎসকের কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করেছিলাম। জাতি বিগত জোট সরকারের আমলে ড্যাবের দৌরাত্ম্য দেখেছে। নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডার বণ্টনসহ লুটপাটের এমন কোনো পথ বাকি ছিল না, যা তারা করেনি। ভিসি নিয়োগ থেকে শুরু করে পিয়ন, সুইপার নিয়োগ পর্যন্ত কোনো কিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে হওয়ার উপায় ছিল না। এখন দেখছি সেই একই ভূমিকায় নেমেছে স্বাচিপ। কোথাও কোথাও তাদের কর্মকাণ্ড ড্যাবের অপকর্মের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারের ১১ ধারায় বলা হয়েছিল, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পূর্বতন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি পুনর্মূল্যায়ন করে যুগের চাহিদা অনুযায়ী নবায়ন করা হবে। এই নীতির আলোকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু, পুষ্টি, শিশু ও মাতৃমঙ্গল নিশ্চিত করা হবে। জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগী করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু সেই স্বাস্থ্যনীতি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনো কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেনি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্গুলোও নামেই কেবল তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এগিয়েছে বলেও জানা যায় না। অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখনো অ্যাম্বুলেন্স নেই। থাকলেও অচল হয়ে পড়ে আছে। বৃদ্ধ, গুরুতর অসুস্থ, প্রসব বেদনায় কাতর কোনো নারীকে বাঁশের খাটিয়ায়, নয়তো রিকশায় করে হাসপাতালে আনতে হয়। সে রকম ছবি প্রায়ই দেখা যায় পত্রিকার পাতায়। হাসপাতালগুলোতে এঙ্-রে মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার উন্নত যন্ত্রপাতি নেই বললেই চলে। কোথাও কোথাও এঙ্-রে মেশিন থাকলেও সামান্য সংস্কারের অভাবে তা অচল হয়ে পড়ে আছে। কোথাও কোথাও তা পরিত্যক্ত লোহা-লক্কড়ে পরিণত হয়েছে। এর প্রধান কারণ, গত ১০ বছরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্গুলোতে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি বললেই চলে। কিন্তু গ্রামের এই মানুষগুলো অসুখ-বিসুখে, বিপদ-আপদে যাবে কোথায়? যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেই মানুষগুলোর পক্ষে বাইরে থেকে কিংবা দূরের শহরে গিয়ে এসব পরীক্ষা করানো কি সম্ভব? তখন নীরবে অসুখকে মেনে নেওয়া এবং মৃত্যুর অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের পক্ষে আর কী-ই বা করার থাকে?
সম্ভবত এসব বিবেচনা থেকেই প্রধানমন্ত্রী বারবার চিকিৎসকদের প্রতি গ্রামের দরিদ্র মানুষের সেবায় আরো বেশি আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার পরও গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকদের অব্যাহত অনুপস্থিতির খবরে তিনি মর্মাহত হয়েছেন। রাগান্বিত হয়ে চিকিৎসকদের প্রতি ধমকের সুরেও কথা বলেছেন। বলেছেন, গ্রামে থাকতে ভালো না লাগলে চাকরি ছেড়ে দিন। কিন্তু তার পরও গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার মানে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। এর কারণগুলোও একই সঙ্গে খুঁজে দেখতে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে।
চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষগুলোর সরকারি স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার অন্যতম কারণ, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্ইে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। এঙ্-রে মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাম বা এ জাতীয় কিছুটা দামি যন্ত্রপাতি তো নেই-ই। আবার কোথাও দেখা যায় এঙ্-রে মেশিন আছে, কিন্তু বিকল হয়ে পড়ে আছে। একই অবস্থা প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায়ও। হয় যন্ত্রপাতি বিকল, না হয় ইনগ্রেডিয়েন্ট নেই। আবার অনেক জায়গায় মেশিন আছে, ইনগ্রেডিয়েন্ট আছে_কিন্তু টেকনিশিয়ান নেই। তাই চিকিৎসকরা বাধ্য হন রোগীদের বাইরে পাঠাতে। তাঁরা জানেন, বাইরের এঙ্-রে মেশিনটিও মানসম্মত নয়, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট ঠিকমতো পাওয়া যাবে না_কিন্তু তিনি অসহায়। অথচ চিকিৎসকদের এসবের ওপর ভিত্তি করেই চিকিৎসাপত্র দিতে হয় এবং জেনেশুনেই দিতে হয় যে এতে রোগ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম। মানবিক বোধসম্পন্ন একজন চিকিৎসকের কাছে এটি আত্মপ্রবঞ্চনা, অনৈতিক এবং একই সঙ্গে হতাশাজনক মনে হতেই পারে। এ কারণেও অনেক চিকিৎসক গ্রামে কাজ করতে আগ্রহী হন না।
আরেকটি বিষয় প্রধানমন্ত্রীকে বিবেচনায় নিতেই হবে। তা না হলে চিকিৎসকদের প্রতি এক ধরনের অবিচার করা হবে। সেটি হলো, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। এমন অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে যে একজন চিকিৎসক উপজেলায় কর্মজীবন শুরু করে সেখানেই তা শেষ করেছেন। উচ্চতর শিক্ষা, উন্নত প্রশিক্ষণ_কিছুই তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। কারণ তিনি কখনো ড্যাব কিংবা স্বাচিপের নেতা হওয়ার বা নেতাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাননি। অথবা এ ধরনের সুযোগ পেশাগত শপথের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় তিনি হয়তো তা নেওয়াকে অনৈতিক মনে করেন। সে কারণেই কোনো কোনো চিকিৎসক উপজেলায়ই কর্মজীবন শেষ করতে বাধ্য হন। কিন্তু একজন তরুণ চিকিৎসকের মনে উচ্চতর শিক্ষার স্বপ্ন থাকতে পারে, পেশাগত উৎকর্ষের স্বপ্ন থাকতে পারে_তিনি তাঁর স্বপ্ন আর বাস্তবতাকে মেলাবেন কী করে? কাজেই চিকিৎসকদের যেমন গ্রামমুখী হতে হবে, তেমনি সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোও মানসম্মত করতে হবে। একজন চিকিৎসক যেন সন্তুষ্টি নিয়ে সেখানে কাজ করতে পারেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্যগুলো জানার সুযোগ যেন তাঁর থাকে, পেশাগত উৎকর্ষের জন্য পক্ষপাতহীনভাবে প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ পেতে পারেন_সে রকম ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। তখন আমাদের এই মেধাবী তরুণদের আর ধমক দেওয়ার প্রয়োজন হবে না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দেখবেন, তাঁরা নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকেই গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষকে সেবা দিতে এগিয়ে যাবেন। অন্তত এটি আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
আমাদের সামনে আরো দুর্দিন অপেক্ষা করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কলেরা, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মতো পুরনো অনেক রোগই নতুন করে মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। বন্যার প্রকোপ ক্রমে বাড়তেই থাকবে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকবে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ইত্যাদি। অত্যধিক পরিবেশদূষণের কারণে ক্যান্সার, ফুসফুস ও যকৃতের রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ইতিমধ্যেই কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেবল বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১৫ হাজার মানুষ মারা যায় বলে তথ্য পাওয়া যায়। বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেখানে বর্তমান স্বাস্থ্যসেবার চাহিদাই পূরণ করতে পারছে না, সেখানে আগামী দিনগুলোর কয়েক গুণ বর্ধিত চাহিদা পূরণ করবে কিভাবে? সে জন্য এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
আমরা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করছি, মহাজোট সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে আরো বেশি মনোযোগী হবে। শুধু আজকের নয়, আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে গড়ে তোলা হোক।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.