চারদিক-ব্যাঙবাজি হাতে বৃদ্ধ by শারমিন নাহার

সময়টা শ্রাবণ, তাই বৃষ্টির দারুণ রকমের বাড়াবাড়িকে বাহুল্য না বলাই ভালো। অনেকেই হয়তো রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষাযাপন’ কবিতার রাজধানী কলকাতার মতো নগর ঢাকায় ঘরে বসেই বর্ষাযাপনটা সেরে নিতে চান। তবে যাঁদের বর্ষাযাপনের সাধ মনে জাগে না বরং বর্ষাকে চরম শক্র মনে হয়, তাঁদেরই একজন মোহাম্মাদ তোয়েব আলী।


থাকেন পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে। মূল বাড়িটা অবশ্য লালবাগেই ছিল। তবে এলাকার ক্ষমতাশালীদের কুক্ষিগত হয়েছে আরও বছর বারো আগে।
তৃষিত নগর যখন বৃষ্টির অপেক্ষা করে, তখন মনেপ্রাণে মোহাম্মাদ তোয়েব আলী চান ঝকঝকে একটা রোদ উঠুক। রোদ মানেই রোজগারের ব্যবস্থা সেদিন হবে ঠিকঠাক। চলতি পথের গাড়ির জানালা থাকবে খোলা, তাই বিক্রি হবে ভালো।
দুপুর দুইটায় ঝুম বৃষ্টি শেষে তখন ঝকঝকে একটা রোদ উঠেছে। রাস্তার পাশের যাত্রীছাউনিতে না দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখেই রাস্তায় নেমে গেছেন তোয়েব আলী। ধানমন্ডি ২৮ নম্বর সড়ক দিয়ে হেঁটে হেঁটে পুতুল বিক্রি করেন তিনি। এই একটা রাস্তাতেই তিনি কাগজের পুতুল আর ব্যাঙবাজি (মাটি দিয়ে বানানো খেলনা, ঘোরালেই শব্দ হয়) বিক্রি করছেন প্রায় ১০ বছর ধরে। আর পুতুলের আকার কিছুটা ভিন্ন, পুতুলের নিচের অংশে রয়েছে দুটি কাগজ। কাগজ টানলেই এই পুতুল নড়ে। মনে হয়, এ যেন এক পুতুলনাচ। পুতুলনাচের সময় তিনি মুখে ছড়া কাটেন ‘দুদিনের এই দুনিয়াতে মানুষ তো ভাই পুতুল’—এজাতীয় নানা আধ্যাত্ম্য কথা।
বৃষ্টির পর রোদের তেজ স্বভাবতই একটু বেশি হয়। আর এই রোদেই ঘাম ঝরিয়ে হেঁটে হেঁটে পুতুল বিক্রি করে চলেছেন মোহাম্মাদ তোয়েব আলী। ট্রাফিক জ্যাম আর লাল বাতিতে থেমে থাকা গাড়িগুলোকে আশীর্বাদই মনে হয় তোয়েব আলীর কাছে। তাই এ সময় কথা বলতে চান না তিনি। তবে জ্যাম ছুটতেই আগ্রহভরেই এসে বলেন, ‘কন বাবা কী কইবেন?’
মাথার চুল বেশির ভাগই পাক ধরেছে তাঁর। বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়েছেন। বাড়িতে কে কে আছে? একটু থেমেই যেন গড়গড় করে পেটের কথা উগরে দেন তোয়েব আলী ‘বউ আর বাইল-বাইচ্চা। বউ আমারে কামে সাহায্য করে। পুতুল বানাই কাগজ দিয়া, তার উপরে কয়েক পরত রঙের আঁচড় দিতে হয়। পুরা কামেই হে থাহে। আর ব্যাঙবাজি বানাইতে লাল মাটি দরকার হয়। বউ চরের থেইকা (কামরাঙ্গীরচর) লালমাটি আইন্যা দেয়। এর পরে নয়া বাজার থেইকা গরুর ল্যাজের চুল আর বাঁশ কিন্যা আনি আমি। এ্যার পরে পুতুল আর ব্যাঙবাজি বানাই।’
অন্য যেকোনো ব্যবসা না করে এ ব্যবসা কেন করছেন?
‘আগে কেল্লার মোড়ে (লালবাগের কেল্লা) কাঁচামালের ব্যবসা (কাঁচা সবজির) করতাম। তয় ১৯৯৮-এর বড় বন্যার পরে সব শ্যাষ হইয়া যায়। এখন ট্যাকা নাই যে অন্য কোনো ব্যবসাপাতি করব।’
ছেলেমেয়েরা কী করে?
‘একটা পোলা ছোড, তয় সে এখনই কারখানায় কাম ধরছে। আর মাইয়া ডাঙ্গর হইছে। বিয়া দিমু তাই ঘর তউন বাইরায় না। মাইয়া বিয়া দিতে ট্যাকা লাগে কিন্তু আমার ট্যাকা কই? খাওনের ট্যাকা নাই, মাইয়া বিয়া দিমু ক্যামনে?’
দিনের শুরুটা হয় কীভাবে?
‘সকাল থেইকা আমি আর বউ মিল্ল্যা পুতুল বানাই। এক দিনে প্রায় ১০০-২০০টা পুতুল বানাই। বেলা বাড়তে বাড়তেই চলে আসি এই হানে। হাঁইট্যা আসি, তাই এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। বিয়ান বেলা প্যাট ভইরা খাইয়া আসি, যাতে দুপুর বেলা না খাওন লাগে। দুপুরে খিদা লাগলে চা আর রুটি খাই।’ চায়ের গুণ সম্পর্কে জানান, ‘চা খাইলে খিদা মইরা যায় তাই বারেবারেই চা খাই।’
কথার ফাঁকেই এদিক-ওদিকে তাকান তিনি, যদি কোনো গাড়ির জানালা খোলা থাকে, জানালা দিয়ে কেউ ডাক দেয়। কিংবা কেউ যদি রিকশা থামায়, হাত ইশারা করে ডাকে। তবেই হয়তো বিক্রি হবে কয়েকটি পুতুল।
তোয়েব আলী বলেন, ‘এই ব্যবসায় আনন্দ আছে, মানুষ আনন্দ পায়, মানুষরে আনন্দ দিয়্যাই ভালো লাগে। না কিনলেও অনেকে ডাইক্যা কথা কয়। মনডা ভালা হইয়া যায়।’
প্রশ্ন করি, আপনার পুতুলের মধ্যে নারী আর পুরুষ কোনটা?
ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি তাঁর। ‘সব মানুষ তো বাবা সমান। বেডা-বেডি কী?’
বেচাকেনা কয়টা পর্যন্ত করেন?
‘সন্ধ্যা পর্যন্ত, ২০০-৩০০ টাকা বেচাবিক্রি হয়। তাতে সংসার চলে না।’
সবকিছুর পরও খেলনার থলে হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরেন এক বুক আশা নিয়ে, আগামীকাল হয়তো ভালো বিক্রি হবে, সন্তানদের জন্য ভালো-মন্দ কিছু কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
তবে ভাগ্যের চাকা ঘোরে না তাঁর, ঠিক যেন কাগজের পুতুলের মতো স্থবির হয়ে থাকে।
তবুও স্বপ্ন থাকে। নতুন ভোর হয়তো একদিন ঠিকই তাঁর কষ্ট দূর করে দেবে।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.