রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আজকের এই মহতি অনুষ্ঠানের সভাপতি,
ভারতের মাননীয় উপ-রাষ্ট্রপতি জনাব হামিদ আনসারি,
সহকর্মীবৃন্দ এবং সমবেত সুধীবৃন্দ।


আসসালামু আলাইকুম।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ১৪০০ সাল কবিতায় বলেছিলেন :
'আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহল ভরে,
আজি হতে শতবর্ষ পরে!'
আমাদের সংগ্রাম ও আন্দোলনের প্রেরণার আরেক উৎস বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবিগুরুর এ কবিতা পড়ে একই শিরোনামে তিনি লিখেছিলেন :
'আজি হতে শতবর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে
আজি হতে শতবর্ষ আগে!'
আজ ১৪১৮ বঙ্গাব্দে কবিগুরুর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর এই শুভক্ষণে বাংলাদেশের সব মানুষের পক্ষ থেকে আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি।
রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন, লেখক নন; তিনি বাঙালির ব্যক্তি ও সমাজজীবনের উজ্জ্বল বাতিঘর। আমাদের প্রেম ও বিরহ, দ্রোহ ও শান্তিতে রবীন্দ্রনাথ থাকেন হৃদয়ের কাছের মানুষ হয়ে। তাঁর সৃষ্টির ঝরনাধারায় আমরা সিক্ত হই প্রতিনিয়ত।
ছোটবেলায় আমার বাবা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভরাট উদাত্ত গলায় আবৃত্তি শুনতাম : 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে...' অথবা 'উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।'
আজ যখন আমরা রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করছি, তখন আমার আব্বাকে বারবার মনে পড়ছে। তিনি সময় পেলেই আবৃত্তি করতেন তাঁর প্রিয় পঙ্ক্তি :
"এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে
সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে
গভীর ক্রন্দন 'যেতে নাহি দিব'। হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।"
আমরা আপনজনদের আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই, কিন্তু সবাইকেই একদিন এই ধরণী ছেড়ে চলে যেতে হয়। থাকে শুধু তার স্মৃতি ও কীর্তি।
আমার রবীন্দ্রনাথ পাঠের হাতেখড়ি হয়েছিল আব্বার কাছে। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে আমার সুযোগ হয়েছিল আরো ব্যাপকভাবে রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর সাহিত্যকে জানার।
বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের উনিশটি বছর কেটেছে জেলে। গ্রেপ্তারের সময় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি আমার মা দিয়ে দিতেন তাঁর জেলজীবনের প্রিয় সঙ্গী বইপত্রের সঙ্গে রবীন্দ্র রচনাবলিও।
সংকট ও প্রতিকূলতার প্রতিটি সময়ে রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতা আমাকেও অনুপ্রাণিত করেছে মাথানত না করতে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের নির্জন কারাবাসের সেই দিনগুলোতে সব সময়ের মতো ফজরের নামাজ পড়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করে দিন শুরু করতাম। এরপর দিন কাটত বই পড়ে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে আমি মানসিকভাবে উজ্জীবিত হতাম।
আজকের এই অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন ভারতের মাননীয় উপ-রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ হামিদ আনসারি। আমাদের এই দুই রাষ্ট্রের মৈত্রী ও বন্ধুত্বের সেতু হয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। দুটি দেশের জাতীয় সংগীতও তাঁরই রচনা।
তাঁর জন্ম কলকাতায়। কিন্তু জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বাংলাদেশের পতিসর, শিলাইদহ আর শাহজাদপুরে। জমিদারি দেখাশোনার কাজে এলেও তিনি গরিব প্রজার কল্যাণে কাজ করেছেন। তাদের সুখ-দুঃখের সাথি হয়েছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন নদীমাতৃক গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি, আর আমাদের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজকে। সৃষ্টি করেছেন অসামান্য সব গান, কবিতা, উপন্যাস ও ছোটগল্প। পতিসরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৃষি-সমবায়। প্রবর্তন করেছিলেন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি।
সাম্প্রদায়িকতার ঊধর্ে্ব উঠে বিশ্বমানব হওয়ার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তাতেও রয়েছে শিলাইদহ তথা কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউলদের প্রভাব। বাউল গান, বিশেষভাবে লালন সাঁইয়ের গানে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন লোকজীবনে বহমান সম্প্র্রীতির ধারার পরিচয়। তিনি নিজে তাঁর রচনা এবং বক্তৃতায় এর উল্লেখ করেছেন।
আরেকটি কথা না বললেই নয়। তা হলো, কলকাতা বা অন্য কোথাও নয়, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বিয়ে করেছিলেন এই বাংলাদেশেরই খুলনার দক্ষিণডিহি গ্রামের মেয়ে ভবতারিণীকে। বিয়ের পর যাঁকে নতুন নাম দিয়েছিলেন মৃণালিনী।
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য আমাদের সরকার শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। সংরক্ষণ করা হয়েছে শাহজাদপুর ও পতিসরের রবীন্দ্র স্মৃতি।
আমার ভারত সফরকালীন যৌথ ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর এই অনুষ্ঠান বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালন করছে।
এ উপলক্ষে ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে যে বিশেষ ট্রেন চলবে, তার নামকরণ করার অনুরোধ জানিয়ে আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন ভারত সরকারের রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে এল আমার প্রিয় রবীন্দ্রকাব্যের পঙ্ক্তি, 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট এ তরী, আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।' ট্রেনের নামকরণ করলাম 'সোনার তরী'। ভারত সরকার সেই নাম গ্রহণ করল। তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি বিশ্বদরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা ভাষাকে।
অন্যদিকে ১৯৪৮ সালে সেই দিনের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার লড়াই। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিকসহ শহীদদের রক্তের বিনিময়ে সেই বাংলা ভাষাকে আমরা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলাম।
কয়েকজন দেশপ্রেমিক প্রবাসী বাঙালি এবং গত মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় একুশে ফেব্রুয়ারি আজ জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
আমাদের ভাষার লড়াই থেকেই শুরু হয়েছিল স্বাধিকারের লড়াই। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর সাহিত্য ও গানকে নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টা করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ। সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করেছিলাম আমাদের হৃদয়ে, চেতনায় ও বিশ্বাসে।
সেই দিন যাঁরা রবীন্দ্র সাহিত্য নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের সোনার বাংলা।
মুক্তিসংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল দেশের জন্য জীবন দিতে। প্রেম ও প্রার্থনার রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন আমাদের রক্তাক্ত সংগ্রামের অন্যতম উৎসাহদাতা। তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন দেশকে ভালোবাসার আবেগ নিয়ে সৃষ্ট রবীন্দ্রসংগীত 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।'
রবীন্দ্রনাথের সময়ের অচলায়তন সমাজব্যবস্থায় নারী যখন অবরোধবাসিনী তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'সবলা' কবিতায় লিখেছিলেন :
'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার
হে বিধাতা?'
তাঁর সৃষ্ট নারীচরিত্র রক্তকরবীর নন্দিনী, গোরার সুচরিতা, ঘরে-বাইরের বিমলা ও চার অধ্যায়ের এলা আজও হার না মানা নারীর প্রতীক হিসেবে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।
দেশ ও মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার কারণেই জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ সেনাদের গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি নাইট উপাধি বর্জন করেছিলেন। তাঁর গোরা ও চার অধ্যায় উপন্যাসে উঠে এসেছিল ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের চিত্র। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটক সেই দিনের তরুণ সমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে।
রবীন্দ্রনাথ শুধু কবিই ছিলেন না, ছিলেন একজন সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন আজ বিশ্বস্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। কৃষি উন্নয়ন, চিকিৎসা, সমবায় ও কুটিরশিল্প-সংক্রান্ত তাঁর ভাবনার ফসল হিসেবে শান্তিনিকেতনের পাশেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীনিকেতন।
রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের স্বদেশ ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত স্বদেশ। যেখানে কৃষক এবং খেটে খাওয়া শ্রমিক পাবে মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে চলার স্বাধীনতা। নারী পাবে তার বেঁচে থাকার অধিকার।
একই স্বপ্নের পথচলায় বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই করে গেছেন এমন এক বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য, যে দেশের প্রতিটি নাগরিক উন্নত জীবনের অধিকারী হবে।
আমি বিশ্বাস করি, একটি দেশ বা অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র হলে তার মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সে দেশ বা জাতি মাথা উঁচু করে চলতে পারে না।
রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করে আমরা গড়ে তুলতে চাই একটি সমৃদ্ধ, আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। একটি যথার্থ কল্যাণরাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়ার শতকোটি মানুষের প্রধান শত্রু দারিদ্র্য। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করে যাব।
প্রিয় সুধীবৃন্দ,
বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি যত দিন থাকবে, তত দিন আমাদের মনের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর স্বপ্ন আর জীবনদর্শন এই মহান মানুষটিকে শুধু বাঙালি বা ভারতীয় পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রাখেনি, স্বদেশের গণ্ডি পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ আজ বিশ্বজনীন, যথার্থ অর্থেই বিশ্বকবি। তাঁর জন্মের দেড় শ বছর পর তিনি আজও আমাদের চেতনায় জাগ্রত হয়ে আছেন।
অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ে, জীবন-সংগ্রামের প্রতিটি ক্রান্তিকালে আমাদের পাশে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়ই বলতে হয় :
'রূপনারায়ণের কুলে
জেগে উঠিলাম;
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ_
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম_
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন_
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে'
সবাইকে আবারও অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালার শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।
খোদা হাফেজ।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

No comments

Powered by Blogger.