সশস্ত্র বাহিনী দিবস by আনোয়ার হোসেন

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবের পথচলার একচলি্লশ বছর আজ পূর্ণ হচ্ছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে আক্রমণের সূচনা করে। এ আক্রমণের সাফল্য এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্রুত পরিসমাপ্তিতে তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
ওইদিন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে সারাবিশ্বের রাষ্ট্র ও জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়েছিল আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। এই অভিযানের ফলে স্পষ্ট বার্তা পেঁৗছে গিয়েছিল বিশ্বের সব মহলের কাছে; বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা যুদ্ধ নিজেরাই চালাতে সক্ষম এবং তার সেনাবাহিনী পৃথিবীর যে কোনো সেনাবাহিনীর সঙ্গে একই মর্যাদাপ্রাপ্তির যোগ্য। এই সম্মিলিত আক্রমণের ব্যাপক সাফল্য ওই সময়ে বিরাজমান চরম অনিশ্চয়তার পরিবেশে জনগণের নৈতিক মনোবল বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ছিল মোক্ষম দাওয়াই, বিশেষ করে যুদ্ধরত মুক্তিসেনাদের জন্য। আর ২১ নভেম্বরের কয়েক দিনের মধ্যেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনী বা যৌথবাহিনী। মিত্রবাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ভারত আশ্বস্ত করেছিল যে, রাজনৈতিক স্বীকৃতি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র; যে স্বীকৃতি ভারত প্রদান করেছিল ৬ ডিসেম্বর। যৌথ বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চারদিকের সীমান্ত দিয়ে আনুষ্ঠানিক আক্রমণ শুরু করেছিল ৩ ডিসেম্বর। মাত্র ১৩ দিনের মাথায় ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে।
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এখন পেশাগত উৎকর্ষতায় বিশ্বের যে কোনো সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে তুলনীয়। সেনাবাহিনী তার নিজস্ব সব উপাদান সহকারে স্বয়ংসম্পূর্ণ; নিজস্ব এভিয়েশন শাখার রয়েছে হেলিকপ্টারসহ সীমিত আকারের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন ছোট বিমান। নৌবাহিনীর রয়েছে আধুনিক ফ্রিগেট বা যুদ্ধজাহাজ। মিগ-২৯ এখন বিমান বাহিনীর আধুনিক সংযোজন।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ এখন বিশ্বের সর্বত্র আলোচিত বিষয়। ১৯৯১ সালে কুয়েত পুনর্দখল অভিযানে বহুজাতিক বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অপারেশন 'ডেজার্ট স্টর্মে' অংশগ্রহণের ফলে বিশ্বব্যাপী শান্তি মিশনে মোতায়েনের জন্য জাতিসংঘ থেকে অনবরত ডাক আসতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বিশ্বের এক নম্বর দেশের মর্যাদা অর্জন করে। বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পোন্নত দেশের জন্য এমন সম্মানজনক অর্জন এবং বহির্বিশ্বে তার প্রচার নিঃসন্দেহে জাতিসংঘের ১৯৮টি সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এখন বাংলাদেশকে শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য একটি মডেল হিসেবে গণ্য করছে। তৈরি পোশাক ও বিদেশে কর্মরত বেসামরিক জনবল খাতের পর, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী।
১৯৯৩ সালের ৫ জুন সোমালিয়ার বিদ্রোহী নেতা জেনারেল ফারাহ মুহাম্মদ আইদিদের বিদ্রোহী সেনাদল শান্তি মিশনে নিয়োজিত পাকিস্তানের ২৪ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ জন সেনাসদস্যকে এক ভয়াবহ আক্রমণের মাধ্যমে হত্যা করে। ঘটনার জের ধরে জাতিসংঘ সোমালিয়ার শান্তি মিশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সব দেশের ফোর্স যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাহারের আদেশ দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের ফোর্সের প্রত্যাহারকালীন সব ধরনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পড়েছিল সেখানে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাদলের ওপর। সেদিন বাংলাদেশ সেনাদল ওই দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করতে পারায় বিশ্ব দরবারে দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল তারা। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এই যে এত বড় অর্জন, তা একদিনে হয়ে যায়নি। ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মিশনে নিয়োজিত সেনাসদস্যদের প্রমাণ করতে হয়েছে, তারা পেশাগত দায়িত্ব পালনে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ থেকে পিছিয়ে নেই। এই কষ্টার্জিত অর্জন যেমন আমাদের ধরে রাখতে হবে, তেমনি দেশের নাগরিক হিসেবে সবার কাম্য হবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পেশাগত উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে মনস্তাত্তি্বকতা এবং দর্শনেও সমগ্র জাতির প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে।

No comments

Powered by Blogger.