সমাজ-নাম নিয়ে যত কথা by আলী কবীর

নামে কীবা আসে যায়? অনেকে বলেন এ কথা। কিন্তু তারাও সুন্দর নাম পছন্দ করেন, তা মানুষের হোক কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের।
কিন্তু নামকরণের ক্ষেত্রে আমরা অনেক বিচিত্র ও দুর্বোধ্য, এমনকি ভুল ধারণাও পোষণ করি।
যেমন_ আমাদের দেশে অধুনা বাচ্চাদের ভালো নাম বা আসল নাম রাখতে গিয়ে জটিল ও অশ্রুতপূর্ব নাম রাখা হয়। এগুলোর বেশিরভাগই হিন্দি, উর্দু (অর্থাৎ হিন্দুস্তানি), ফার্সি, এমনকি পশতু। উল্লেখ্য, হিন্দির মতো উর্দুও একটি ভারতীয় ভাষা। দেশ বিভাগের আগে এ দুটিকে পৃথক ভাষা হিসেবে গণ্য করা হতো না। দুটি ভাষাকে একসঙ্গে বলা হতো হিন্দুস্তানি অর্থাৎ উত্তর ভারত বা আর্যাবর্তের ভাষা।
আমার এক বন্ধু জেনে মর্মাহত হলেন যে, ইরাকের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী তারেক আজিজ খ্রিস্টান। তিনি তাকে মুসলিম বলে ভেবেছিলেন। আমি তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, নামের জন্য। তার নামটা তো মুসলমান নাম। আমি তাকে জানালাম, ওটা মুসলমান নাম নয়, আরবি নাম। ভদ্রলোকের মাতৃভাষা আরবি। তাই তার বাবা-মা ওই ভাষায়ই ছেলের নামকরণ করেছিলেন। আমি তাকে আরও বললাম, কে তাকে নিষেধ করেছে মাতৃভাষায় নিজের নাম রাখতে? তিনি যেন তার ছেলেমেয়ের নামকরণের ক্ষেত্রে বিষয়টি খেয়াল রাখেন ইত্যাদি।
ভদ্রলোক আমার কথায় কতটুকু গুরুত্ব দিলেন জানি না; কিন্তু আমাদের দেশেও অনেকে মাতৃভাষায় শিশুদের নামকরণ করেন, বিশেষ করে ডাকনাম। অনেকেই ছেলেমেয়েদের সুন্দর ও অর্থবহ বাংলা ডাকনাম রাখেন; কিন্তু এই বাংলা ডাকনামকে হিন্দু নাম বলে ভুল করা বা বিদ্রূপ করার মতো লোকেরও অভাব নেই। ভাষা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত পানি বা জল। অনেকেই খাঁটি বাংলা শব্দ জলকে একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের সঙ্গে এক করে দেখি এবং খাঁটি হিন্দি শব্দ পানিকে আপন মনে করি। পানি শুধু হিন্দি শব্দ নয়, এটি সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত।
নাম ও পরিধেয় পোশাকের যে কোনো ধর্ম বা জাত নেই, তা বহু আগে বলে গেছেন আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল পাশা, যাকে তুর্কিরা শ্রদ্ধাভরে আতাতুর্ক বা তুরস্কের জনক বলে থাকেন। মূলত তার সময় থেকেই নতুন করে তুর্কি জনগণ মান্ধাতা আমলের আলখাল্লা পরিত্যাগ করে আধুনিক পোশাক-আশাক পরিধান করতে শুরু করে। এর আগে তুর্কিরা হাস্যকর এক জাব্বা-জোব্বা পরত, যাকে তাদের অনেকেই ইসলামী পোশাক বলে মনে করত। তুরস্কের মানুষকে আধুনিক পোশাক পরিধানে উদ্বুদ্ধ করতে কামালকে এ বিষয়ের ওপর জাতির উদ্দেশে একটি বেতার ভাষণ পর্যন্ত
দিতে হয়েছিল।
কেউ কেউ আবার মানুষের নামকে খানিকটা পরিবর্তন করে বলতে পছন্দ করেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ড. সুকর্ণকে আজাদ পত্রিকায় শোকরানা লেখা হতো এবং অনেকেই তাকে আহমেদ শোকরানা নামে পরিচিত করতে চাইত; কিন্তু তার নাম নিয়ে বিভ্রান্তির অবসানে তিনি নিজেই ব্যবস্থা নিলেন। তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তার আত্মজীবনী গু ঝঃড়ৎু বা 'আমার কথা'র প্রথম কিস্তিতে তার নিজের নামকরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, মহাভারতের বীর কর্ণের নাম অনুসারে আমার মা আমার নাম রাখেন সুকর্ণ। বলাবাহুল্য, তার নামটি রাখা হয়েছিল মাতৃভাষা বাহাসা ইন্দোনেশিয়া অর্থাৎ ইন্দোনেশীয় ভাষায়। স্বাভাবিকভাবেই এ রাষ্ট্রনায়ক তার মেয়ের নামও নিজ ভাষায় রাখেন মেঘাওয়াতি 'সুকর্ণপুত্রী'। অর্থাৎ সুকর্ণের মেয়ে মেঘবতী। তিনি বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।
আরেকটি বিষয় ভেবে আমি অবাক হই। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, তার পরিচিত একটি পরিবারের চার কন্যার নাম এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের চারটি রাজধানী বা বৃহৎ নগরীর নামে রাখা হয়েছে। এ চার কন্যার নাম হংকং, সিডনি, ম্যানিলা ও টোকিও। এ ধরনের বিচিত্র নামকরণ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা এসব নিয়ে কিছু বলি না; কিন্তু একশ্রেণীর মানুষের মাথাব্যথা শুরু হয় যখন তাদের পরিচিত কেউ বা কোনো আত্মীয় বাংলা ভাষায় ছেলেমেয়ের নামকরণ করেন। তারা এ নিয়ে আপত্তি তোলেন এবং বিচিত্র ও উৎকট সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলেন।
একশ্রেণীর মানুষ আবার নিজেদের নাম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। স্পষ্টতই তারা বাবা-মায়ের দেওয়া নাম নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তাদের জীবনে বিত্ত-বৈভব ও পদ-পদবি পরিবর্তনজনিত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজ নামে কিংবা নামের বানানে পরিবর্তন করে নামকে যুগোপযোগী বা লাগসই করার চেষ্টা করেন। এর ধারাবাহিকতায় হোসেন হয়ে যান হুসাইন, কামাল হয়ে যান কেমাল, আহাম্মদ হয়ে যান আহমাদ, রহমান হয়ে যান রাহমান ইত্যাদি।
তবে সবার ওপরে টেক্কা দিয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতা জিন্নাহ। তিনি তার জীবনের এক পর্যায়ে শুধু নিজের নামের পরিবর্তন করে ক্ষান্ত হননি, তার পিতার নামও পরিবর্তন করেছিলেন। তার মূল নাম ছিল মোহামেদ আলী ঝিনাভাই খোজাভি। সেটাকে পরিবর্তন করে তিনি করলেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। একইভাবে তার পিতার মূল নাম ঝিনাভাই পুনজা খোজাভি পরিবর্তন করে নাম রাখা হলো জিন্নাহ পুনজা।
এই ভদ্রলোক পরবর্তী সময়ে তার পৃষ্ঠপোষক ইংরেজ শাসকের সহায়তায় উপমহাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের নাম পাল্টে ডিকশনারি দেখে নাম রাখলেন পাকিস্তান। পৃথিবীতে বোধ করি এই একটি মাত্র রাষ্ট্র, যার নাম ডিকশনারি দেখে রাখা হয়েছে। ফলে সব ভাষায়ই এর একই নাম, আরবি ভাষা ছাড়া। কারণ আরবিতে ইংরেজি চ বা বাংলা প-এর মতো কোনো অক্ষর নেই। জিন্নাহ সাহেবের এই সাধের পাকিস্তান থেকে ১৯৭১ সালে সাবেক পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান রক্তক্ষয়ী এক স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নাম ধারণ করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু তার পরও পাকিস্তানে বহুমাত্রিক সংঘাত ও রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। অর্থাৎ পাকিস্তানিরা এখনও একক ও ঐক্যবদ্ধ একটি জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। হয়তো কোনো দিন পারবেও না। পাকিস্তানের ঘটনাবলি প্রমাণ করে, পাকিস্তান কোনো ঐতিহ্যবাহী দেশ নয়। তাই তার কোনো ঐতিহ্যবাহী নাম নেই। ভারতবর্ষ একটি ঐতিহ্যবাহী দেশ। ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় এর ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। আমাদের দেশও একটি ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তর ভূখণ্ডের অংশ। এরও ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে, এমনকি একই ভাষায় একাধিক নাম রয়েছে। যেমন_ বাংলা, বাঙ্গালা, বঙ্গ, বাংলাদেশ, বঙ্গভূমি ইত্যাদি। এসব নামের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তারা একই ভূখণ্ডকে বোঝায়। 'বাংলাদেশ' আমাদের ভাষায় আমাদের দেশের নিজস্ব নাম। যেমন_ সৌদি আরব এর নিজ ভাষায় নাম হলো আল মামলুকাতুল আরাবিয়াতুস সাউদিয়া, মিসরের নিজ ভাষায় নাম আল মেছর, জাপানের নিজস্ব নাম নিপ্পন বা নিহন এবং কোরিয়ার নিজ নাম হানগুক ইত্যাদি। আরেকটি কথা, ইংরেজিতে আমাদের দেশের নাম লেখা হয় চবড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ইধহমষধফবংয. কিন্তু বাংলায় লেখা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এর কারণ ঠিক বোধগম্য নয়। চবড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ-এর বাংলা তো গণপ্রজাতন্ত্র, গণপ্রজাতন্ত্রী নয়। আমাদের দেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্র। সেই হিসেবে দেশের নাম বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্র লেখাই সমীচীন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-এর মতো দেশের নামটি শেষে লেখার গ্গ্নানি থেকে আমরা অন্তত মুক্তি পাব।

আলী কবীর :সাবেক সচিব, প্রবন্ধকার

No comments

Powered by Blogger.