চরাচর-নকশিকাঁথা by সুস্মিতা সাহা

'নকশী কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারা রাত আঁকে ছবি/ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি/অনেক সুখের-দুঃখের স্মৃতি ওরই বুকে আছে লেখা/তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা...' পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের 'নকশী কাঁথার মাঠ' কবিতাটি সবারই জানা।
নকশিকাঁথা শব্দটি মনে হলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে গ্রামবাংলার চিরচেনা এক ছবি। বাংলার মেয়েরা সুই-সুতার বুননে নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প রচনা করে নকশিকাঁথায়। বলা চলে, একেকটি নকশিকাঁথা হলো একেকটি কবিতা, আর কাঁথাটি যিনি সেলাই করেন, তিনি একই সঙ্গে চিত্রক ও কবি। বয়নশিল্পী রঙিন সুতায় রচনা করেন তাঁর কাব্য। আর তাঁর নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, সমাজ-প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায় নকশিকাঁথা। কোনো কোনো সময় বিষয়বস্তু হিসেবে কাঁথায় উঠে আসে বিভিন্ন লোককথা ও পুরাণ। বিচিত্র রঙের সুতার ফোঁড়ে ফোঁড়ে ফুটে ওঠা নকশাগুলোর আবার বাহারি সব নাম। যেমন- হাসিয়া তাগা বা পয়সা তাগা, ফুল পাড়, বরফিটিপ পাড়, কদম, মসুরি কদম, মুক্তাদানা পাড়, আনাস তাগা, চারি তাগা, বাকি পাড়, শিমুল পাড়, মাছ তাগা, পিরামিড তাগা, কণাটিপ পাড়, এস তাগা, কলসি পাড়, ময় পাড়, শাপলা তাগা, জোড়া পাড় ইত্যাদি। নকশিকাঁথা কালজয়ী ও সর্বজন সমাদৃত একটি লোকজশিল্প। এই শিল্পের চর্চা কবে থেকে শুরু হয়, তা অজানা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নকশিকাঁথা তৈরি হয়ে থাকে। তবে শেরপুর, জামালপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চল নকশিকাঁথার জন্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ।
গ্রামবাংলার এই নকশিকাঁথা শহরে জনপ্রিয় হয়েছে বেশ আগেই। শৌখিন মানুষের কাছে নকশিকাঁথার রয়েছে বিশেষ কদর, যা দিন দিন বাড়ছে এর বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপান্তরের কারণে। বর্তমানে এই কাঁথার ব্যবহার বহুবিধ। গায়ে দেওয়া থেকে শুরু করে গৃহসজ্জা, বিভিন্ন জায়গাতেই এখন নকশিকাঁথা ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকাসহ সারা দেশে নকশিকাঁথাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক ফ্যাশন হাউস। একটা চাদর বা কাঁথা তৈরি করতে সময় লাগে দুই থেকে তিন মাস। একেকটি চাদরের পাইকারি মূল্য এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা এবং কাঁথার দুই হাজার ১০০ থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা। যদিও গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবকাঠামো, বিশেষ করে নারীর আর্থিক ক্ষমতায়নে নকশিকাঁথা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় নকশিকাঁথা শিল্পের কিছুটা বিকাশ হলেও সরকারিভাবে আরো উদ্যোগের প্রয়োজন। পটুয়া কামরুল হাসানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশের নকশিকাঁথা শিল্পে নতুন প্রাণসঞ্চার হয়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়ায় এই শিল্পের তত্ত্বাবধানে। গ্রামীণ হস্তশিল্পটি গ্রাম-শহর নির্বিশেষে আরো সমাদৃত হয়। নকশিকাঁথার শিল্পীদের তিনি ডিজাইন সরবরাহ করেন এবং তাঁদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও সরকারিভাবে পুঁজির ব্যবস্থাও করেন।
সুস্মিতা সাহা

No comments

Powered by Blogger.