বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৭৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. ওসমান গনি, বীর প্রতীক সাহসী এক প্রতিরোধযোদ্ধা
মো. ওসমান গনি চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের রংপুর (১৯ নম্বর) উইংয়ের অধীন চিলমারীতে।
তাঁর পদবি ছিল সুবেদার এবং তিনি একটি কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন। ২৫ মার্চের দু-তিন দিন আগে সুবেদার মেজর হিসেবে তাঁর পদোন্নতি হয়। তাঁকে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে যেতে বলা হয়। তিনি চিলমারী থেকে রংপুর হয়ে দিনাজপুর রওনা হন। এর মধ্যে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। পথে পার্বতীপুর রেলস্টেশনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি আক্রান্ত হয়ে কোনো রকমে বেঁচে যান।
এদিকে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন শেষে দিনাজপুর সার্কিট হাউসে ছিল এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা (২৬ এফএফ রেজিমেন্ট)। কোম্পানিটি পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। মার্চ মাসে তাদের যাত্রা বাতিল করা হয়। ২৮ মার্চ বিকেলে এফএফ রেজিমেন্ট ইপিআর সেক্টরে গোলাবর্ষণ করে। সেক্টর হেডকোয়ার্টারের অবস্থান কুঠিবাড়িতে। এ সময় সেখানে ইপিআরদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো বাঙালি কর্মকর্তা কেউ ছিলেন না। এমনকি সেক্টরের সবচেয়ে প্রবীণ বাঙালি সুবেদার মেজরও (জেসিও বা জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার) অনুপস্থিত ছিলেন।
এ অবস্থায় ইপিআর মর্টার প্লাটুনের বাঙালি সেনারা মর্টারসহ কুঠিবাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। তাঁরা কাঞ্চনে অবস্থান নিয়ে সার্কিট হাউস লক্ষ্য করে পাল্টা গোলাবর্ষণ করেন। মর্টার প্লাটুন তাদের রিয়ার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে কাঞ্চনে। ২৯ মার্চ রাতে দিনাজপুর সেক্টরের বাঙালি ইপিআররা একযোগে বিদ্রোহ করে কাঞ্চনে সমবেত হন।
ওসমান গনি পার্বতীপুর থেকে ৩০ মার্চ কাঞ্চনে পৌঁছে বিদ্রোহী ইপিআরদের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁকে রিয়ার হেডকোয়ার্টারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দিনাজপুর শহরে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনী কাঞ্চনের রিয়ার হেডকোয়ার্টারে কয়েকবার আক্রমণ করে। ওসমান গনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে এ আক্রমণ প্রতিহত করেন। তাঁর নেতৃত্ব ও পরিচালনায় ইপিআর সেনারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
৩১ মার্চ দিনাজপুর শহর মুক্ত হয়। কয়েক দিন পর রংপুর ও সৈয়দপুর থেকে আগত পাকিস্তানি সেনারা দিনাজপুর শহরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদের আক্রমণ করে। অব্যাহত আক্রমণের মুখে কাঞ্চনে অবস্থানরত ওসমান গনিরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই স্থানে যান। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
১২ এপ্রিল ওসমান গনি তাঁর দলের সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিরলে অবস্থান নেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে কয়েক দিন ধরে তাঁর দলের যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিরা ভারী অস্ত্র ও সাঁজোয়া যান নিয়ে কয়েকবার তাঁদের আক্রমণ করে। ওসমান গনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কিন্তু তাঁরা সেখানে টিকে থাকতে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পশ্চাদপসরণ করে নানাবাড়ি নামক স্থানে অবস্থান নেন। দু-তিন দিন পর পাকিস্তানিরা সেখানে আক্রমণ করে। তখন সেখানে ছোটখাটো যুদ্ধ হয়। তাঁরা পিছে হটে কিশোরীগঞ্জে যান।
২৪ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরাট দল ওসমান গনির দলকে আক্রমণ করে। তখন তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালান। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়। এরপর পাকিস্তানিরা ভারতীয় ভূখণ্ডে অনবরত শেলিং করতে থাকে। এতে জানমালের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে তাঁকে সহযোদ্ধাসহ ভারতে যাওয়ার অনুরোধ করে। তখন তিনি বাধ্য হয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতে যান।
ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর ওসমান গনি ৬ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া ছাত্র-যুবকদের মধ্যে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক, তাঁদের মধ্যে থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করেন এবং প্রশিক্ষণ দেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. ওসমান গনিকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৬৮।
মো. ওসমান গনি স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে এডি পদে উন্নীত হয়ে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে অবসর নেন। ১৯৯৯ সালে তিনি মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি পঞ্চগড় জেলার পৌরসভার অন্তর্গত মিঠাপুকুরে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাস করতেন ঢাকায় (৬/৭ ব্লক সি, তাজমহল রোড, মোহাম্মদপুর)। তাঁর বাবার নাম আজিজুল হক। মা আফরিন নেছা। স্ত্রী নাসিম বানু। তাঁদের তিন মেয়ে ও দুই ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, নূরুল ইসলাম তালুকদার এবং মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী, সুকুমার বিশ্বাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.