সশস্ত্র বাহিনী দিবসের গুরুত্ব by ড. মিল্টন বিশ্বাস

২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের সূচনা করে। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সম্মিলিতভাবে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এর আগে ২৫ মার্চ সেনা, ১০ ডিসেম্বর নৌ এবং বিমান বাহিনী ২৮ সেপ্টেম্বর আলাদাভাবে দিবসগুলো পালন করত। পরে ২১ নভেম্বরের তাৎপর্য সমুন্নত রাখতে সম্মিলিত দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালনের পেছনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর অবদানকে সাধারণ জনতার আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত করে দেখা হয় এ দিবসটিতে।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবলীলার জবাবে অস্ত্র তুলে নেয় বিপ্লবী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ, আনসার ও অন্য সদস্যরা। পরবর্তী সময়ে এগিয়ে আসেন পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত বাঙালি নাবিক ও নৌ-অফিসার, সেনা ও বিমান কর্মকর্তারা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় সর্বস্তরের মুক্তিপাগল হাজার হাজার যুবক। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ধারণ করে সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে পাকিস্তানি শাসকদের স্বপ্ন নস্যাৎ ও তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় একটি সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর। মুজিবনগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে (পরবর্তী সময়ে জেনারেল) মুক্তিবাহিনীর প্রধান নিয়োগ করে। তাঁর ওপর মুক্তিবাহিনী পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা দ্রুত নিজেদের সুসংগঠিত করে পাল্টা আক্রমণ করে। সারা দেশকে বিভক্ত করা হয় ১১টি সেক্টরে, যার নেতৃত্ব দেওয়া হয় একেকজন সুশিক্ষিত পেশাদার সেনা কর্মকর্তাকে। আট মাস পর একাত্তর সালের ২১ নভেম্বর চূড়ান্তভাবে সম্মিলিত আক্রমণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সেদিন স্থল, নৌ ও আকাশপথে কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে চালানো হয় ত্রিমুখী আক্রমণ। উন্মুক্ত হয় বিজয়ের পথ। এই আক্রমণ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফলতা লাভ করে জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে। তারা বাধ্য হয় পশ্চাদপসরণে। সুশিক্ষিত একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে সূচিত হয় মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের ইতিহাস। তারপর মিত্রবাহিনীর সহযোগে ঘোষিত হয় সার্বিক যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে চূড়ান্ত বিজয়। প্রকৃতপক্ষে এ বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরের সম্মিলিত আক্রমণ। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক রক্ষিত রয়েছে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারির মিলিটারি একাডেমীতে। অন্যদিকে নেভাল একাডেমীতে নির্মাণাধীন রয়েছে 'বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স'। সেখানকার 'রেডকিন' চত্বরটি মুক্তিযুদ্ধের পরে মাইন অপসারণের সময় নিহত রাশিয়ান নাগরিক শহীদ রেডকিনের নামে করা হয়েছে।
মহাজোট সরকারের প্রায় চার বছরে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে আন্তরিক কর্মযজ্ঞ দেখা গেছে। ইতিপূর্বে ১৯৯৬ সালে এই আওয়ামী লীগ সরকারই তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এপিসি বা Armoured Personnel Carrier, MIG-29 যুদ্ধবিমান, অত্যাধুনিক Class-4 ফ্রিগেট ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে। পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ওয়ার কলেজ, আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ, BIPSOT বা Peace Keeping ইনস্টিটিউট, BUP বা Science & Technology ইনস্টিটিউট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জনবল বাড়ানোর জন্য একটি কম্পোজিট ব্রিগেড, একটি পদাতিক ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস ব্রিগেড ও বেশ কয়েকটি বিভিন্ন ধরনের ব্যাটালিয়নসহ অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এবারও সরকার গঠনের পর নতুন Armoured Personnel Carrier কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত বছর (২০১১) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ফোর্স কমান্ডার বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের পদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। সৈনিকদের কল্যাণের জন্য গ্যারিসনে বা এর আশপাশে পরিবারের সঙ্গে বসবাসের কোটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। অফিসারদের হাউজিং প্লট দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০০৯ সালে বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় জঘন্যতম ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে যেসব সেনা কর্মকর্তা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের জন্য সরকারের নানাবিধ প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। অন্যদিকে হত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য 'দ্রুত বিচার আইনে' বিচারকার্য সম্পন্ন করা হচ্ছে।
কক্সবাজারে বিমান বাহিনীর ঘাঁটি উদ্বোধন করা হয় ২০১১ সালের এপ্রিলে। গত বছরের ১১ জুন তিনটি MI 17 হেলিকপ্টার ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২৭ জুন ১৬টি এফ সেভেন (বিজিআই) বিমান ক্রয়ে চুক্তি হয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে সারফেইস টু এয়ার মিসাইল (SHORAD) সংযোজিত হওয়ার পর পরীক্ষামূলক ফায়ারিং অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের ২৪ অক্টোবর। বিমান বাহিনী একাডেমীতে চারতলাবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু ভবন কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সেইফটি সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে বিমান বাহিনী কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। এ ছাড়া জাপানের সুনামিদুর্গতদের জন্য ত্রাণসামগ্রী জাপানে পৌঁছে দিয়ে বিমান বাহিনী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশের স্বৈর শাসকের একাধিপত্যের কারণে দেশের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সম্বন্ধে বিরূপতা জন্মে জনমনে। একই সঙ্গে ভীতিবোধ ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো যে আমাদের দেশের এবং জনগণের অর্থে পরিচালিত হয়_এ ধরনের সচেতনতা আমাদের মধ্যে এখনো আসেনি।
বাংলাদেশ নেভাল একাডেমী যাত্রা শুরু করে ১৯৭৬ সালে। এটি এক ধরনের সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে এটি অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি অফিসার ক্যাডেট ও সরাসরি ভর্তিকৃত অফিসারদের মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। ক্যাডেটরা এ একাডেমীতে ১৮ মাসের প্রশিক্ষণের শুরুতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমীতে সেনা ও বিমান বাহিনীর ক্যাডেটদের সঙ্গে ১০ সপ্তাহের সম্মিলিত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। একাডেমীর প্রশিক্ষণ শেষে মিডশিপম্যান হিসেবে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তারা ছয় মাসের জন্য যুদ্ধজাহাজে গমন করে। অতঃপর তারা বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে অ্যা. সা. লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করে। পরবর্তী সময়ে প্রায় এক বছর বিভিন্ন ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ শেষে আবার নেভাল একাডেমীতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা সমাপ্তির পর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের অধীনে বিজ্ঞানে স্নাতক (বিএসসি-পাস) ডিগ্রি অর্জন করে। তবে প্রকৌশল ও বিদ্যুৎ প্রকৌশল শাখার অফিসাররা বুয়েট অথবা এমআইএসটিতে অধ্যয়নের পর গ্র্যাজুয়েশন লাভ করে। ক্যাডেট প্রশিক্ষণ ছাড়াও এ একাডেমীতে সরাসরি নিয়োগকৃত অফিসারদের বেসিক কোর্স, জুনিয়র স্টাফ কোর্স, ব্রাঞ্চ র‌্যাংক কমন কোর্স এবং কম্পিউটার কোর্স পরিচালনা করা হয়। ক্যাডেটরা দেড় বছর এ ক্যাম্পাসে অবস্থান করে, কখনো এরও বেশি। তবে প্রশিক্ষণের সফল পরিসমাপ্তি ও কমিশনিং অনুষ্ঠানের পর তারা মাতৃভূমির সেবায় আত্মনিয়োগ করে। বর্তমানে নৌ-শক্তি কেবল যুদ্ধের জন্য নয়; বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে মিলিয়ে নেভাল একাডেমীকে সাজাতে হবে। বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার সামরিক কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কর্মরত। কঙ্গো, নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা বা রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া, হাইতি, তাজিকিস্তান, কসোভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর প্রভৃতি স্থানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল নাম।
১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সম্মিলিত হয়েছিল জনতার সঙ্গে। সেই ঐতিহাসিক সম্পর্ক অর্থাৎ জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর পারস্পরিক সুসম্পর্ক আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি উদ্দীপক বিভাব। জাতির প্রয়োজনে অর্পণ করা কঠিন দায়িত্ব পালনে সশস্ত্র বাহিনীর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা অনন্য। দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ আর জনগণের জন্য ভালোবাসা_এই দুটি বিষয় কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর দেশপ্রেম। শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে_'সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কার সাথে বৈরিতা নয়।' প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক এ জন্য প্রয়োজন। পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সুশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী থাকাটা অন্যতম শর্ত। আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিন বাহিনীর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনার আধুনিকায়ন করে যেতে হবে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে। এই ধারা অব্যাহত রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমুন্নতি বিধানের জন্য সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদ্যাপনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়,
writermiltonbiswas@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.