আলোকিত খুলনায় আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ by মাসুদ পারভেজ

প্রতিদিন সন্ধ্যা নামতে না নামতেই খুলনায় জ্বলে উঠছে 'বিশ্বকাপের আলো'! বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মতো বড় কিছু নয়, আবার এ শহরের জন্য কোনো অংশে কম কিছুও তো হচ্ছে না এখানে। ক্রিকেটেরই সবচেয়ে আদি সংস্করণ টেস্টের আসর যখন বসছে প্রথমবারের মতো, তখন ২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আলোকসজ্জায় ব্যবহৃত উপকরণ দিয়েই নতুন সাজে সেজে ওঠা নগরী এখন জমজমাট লড়াইয়ের অপেক্ষায়।
ঢাকা টেস্টের প্রায় শেষ পর্যন্ত সমানে-সমানে লড়াই যে অপেক্ষার কাতরতা বাড়াচ্ছে আরো। একই রকম আলোকমালায় সেজে ওঠা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অবশ্য বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সের অন্ধকারও ছিল। ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানোর মতো কীর্তি যেমন ছিল, তেমনি এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ৭৮ রানে অলআউট হওয়ার মতো লজ্জাজনক কাণ্ডও ছিল। সব মিলিয়ে ঘরের মাঠের বিশ্বকাপটা বাংলাদেশের জন্য অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা হয়েই আছে। তবে ঢাকা টেস্টের শেষটা বাদ দিলে চলতি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজটা এখন পর্যন্ত 'মধুর'ই আছে। যে কারণে এর সঙ্গে 'অম্ল'ও যোগ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা, সেটিকেই এখন ঝেঁটিয়ে বিদায় করার লক্ষ্য নিয়ে নামছে বাংলাদেশ।
সেটি কী? কী আবার- ব্যাটসম্যানদের নিজেদের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসার বদভ্যাস! যে কারণে ঢাকা টেস্টের শেষদিনে জয়ের প্রবল সম্ভাবনা ঝিলিক দিয়েও মিলিয়ে গেছে হতাশায়। এমন হতাশায় খুলনায়ও গড়াগড়ি খান, সেটা কিছুতেই চাইছেন না বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম, 'আমরা জানি যে ওদের বোলিং অ্যাটাক আমাদের তুলনায় বেশ ভারসাম্যপূর্ণ। ওরা তাই অনেক কিছু করার চেষ্টা করবে। কিন্তু যা-ই করুক না কেন, মাঠে নেমে আমাদের ভালো খেলতে হবে। মূল কথা হলো, নিজেদের উইকেটটা দিয়ে আসা যাবে না। বলতে পারেন খুলনা টেস্টে এটাই বাংলাদেশ দলের থিম।' ব্যাট হাতে যে থিম মেনে চলার ফল ঢাকা টেস্টেই তো দেখেছেন ব্যাটসম্যানরা।
যে টেস্টে ৫৫৬ রান করে এমনকি প্রথম ইনিংসের লিডও নিয়ে ফেলা গেছে; এর ফলে লড়াইয়ের শক্ত ভিত পেয়ে যাওয়া দল প্রতিপক্ষের সঙ্গে যথাসাধ্য পার্থক্য কমিয়ে আনার ধারণাও তো ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। ম্যাচ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে তাই দুই দলের অধিনায়ককেই এমন প্রশ্ন শুনতে হলো যে, 'ঢাকা টেস্টের পারফরম্যান্সের পর এখন দুই দলের পার্থক্য অনেক কমে এসেছে বলে মনে করেন কি?' মুশফিক যে জবাবটা দিলেন, সেটা কি ঢাকা টেস্টের আগেও দেওয়ার সুযোগ ছিল, যখন সামনে মাত্রই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে এসে আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, 'আমি বলব না যে পার্থক্য খুব বেশি বা কম।' একই প্রশ্নে সামির জবাবটা শুনুন, 'র‌্যাংকিংয়ের ১ নম্বরে থাকা দল ৪ নম্বরের কাছে হেরে যায়, ক্রিকেটে এমনটা দেখাই যায়। এটা নির্ভর করে আসলে আপনি মাঠে নেমে নিজেকে কিভাবে মেলে ধরছেন, তার ওপর। ধৈর্য, শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা থাকলে সম্ভব।'
সেসব শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেই ঢাকা টেস্টে জয় বের করে নিয়েছে ক্যারিবীয়রা। যেটিকে নিজেদের জন্যও উন্নতির চিহ্ন ধরছেন সামি, 'এমন পরিস্থিতিতে আমরা আগেও পড়েছি। সেখান থেকে জেতার অর্থই হলো আমরা উন্নতি করছি।' এ জায়গাটায় উন্নতি করার লক্ষ্য নিয়ে দেশের সপ্তম টেস্ট ভেন্যু শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে নামছে বাংলাদেশও; যেখানে আগে খেলার অভিজ্ঞতা নেই মুশফিকের নিজেরও। তবে সতীর্থদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছেন, 'আমি যতদূর জেনেছি, এখানকার উইকেটে ব্যাটসম্যানদের জন্য রান আছে। আবার একই সঙ্গে ম্যাচের শেষদিকে স্পিনারদের জন্য যথেষ্ট টার্নও আছে।' রান যে আছে সেটা কিছুদিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হাই পারফরম্যান্স দলের হয়ে বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া বীরাস্বামী পেরমলের কাছ থেকে জেনেছেন ক্যারিবীয়রাও। বাংলাদেশ 'এ' দলের বিপক্ষে চার দিনের ম্যাচে হাই পারফরম্যান্স দল করেছিল ৫৩৪ রান। স্বাগতিকরা ব্যাটিং ব্যর্থতায় ডুবলেও পেরমল সেই ম্যাচে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। তবে এ মাঠে বাঁ-হাতি স্পিনারদের সাফল্যের ইতিহাসে সোহাগ গাজীর নামটাও ভালোভাবেই আসবে। ঢাকায় দুই ইনিংসে ৯ উইকেট নিয়ে স্বপ্নের অভিষেক হওয়া এই অফস্পিনার গত মাসেই এখানে সাফল্যে উজ্জ্বল ছিলেন জাতীয় লিগ ম্যাচেও। খুলনার বিপক্ষে ম্যাচে ৯ উইকেট, এর মধ্যে দ্বিতীয় ইনিংসেই হ্যাটট্রিকসহ ৭! বরিশালের হয়ে ওই ম্যাচেই তাঁর ব্যাট থেকে আসা ১১৯ রানের ইনিংসটাও ব্যাটসম্যানদের আত্মবিশ্বাসে জ্বালানি হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আর ব্যাটিংয়ের ভুলরোধে মনপ্রাণ সঁপে দেওয়া বাংলাদেশ শিবির শেষ পর্যন্ত তামিম ইকবালকে নিয়েই নামতে পারছে এই টেস্টে। বাঁ কনুইয়ের মাসল টেন্ডনে ব্যথার জন্য তাঁর খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে কাল সকালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, গতকাল দুপুরের দিকে, নয়তো পরের দিন সকালে ফিটনেস পরীক্ষা নেওয়া হবে তামিমের। এ অনিশ্চয়তার কথা শুনে সামিও বলে ফেলেছিলেন, 'ও বাংলাদেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। ওর না থাকা সম্ভবত বাংলাদেশকে ব্যাকফুটেই ঠেলে দেবে।' তবে সেটি দেয়নি শেষ পর্যন্ত। দুপুরে নেটে ব্যাটিংয়ের পরই আবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, কোনো সমস্যা অনুভব করছেন না তামিম। সুতরাং খেলতেও কোনো বাধা নেই। তামিমের 'ব্যাকআপ' হিসেবে খুলনায় উড়ে আসা এনামুল হককে (বিজয়) নিয়ে তাই বাংলাদেশের টেস্ট স্কোয়াডটা হয়ে গেল ১৫ জনের। তাঁর খেলা হচ্ছে না, তবে ঢাকা টেস্টের দুই ইনিংসে বাজেভাবে আউট হওয়া জুনায়েদ সিদ্দীকের জায়গায় তামিমের ওপেনিং পার্টনার হয়ে যাচ্ছেন নাজিমউদ্দিন। এ ছাড়া ঢাকা টেস্টের একাদশটা অপরিবর্তিত রেখেই নামছে বাংলাদেশ।
নামছে ঢাকা টেস্টের শেষ দিকের ব্যাটিংটা আর না করার লক্ষ্য নিয়েও। সেটা করতে পারলে 'বিশ্বকাপের আলো' ঝলমলে শহরটা আরো রঙিন হবে নিশ্চয়ই।

No comments

Powered by Blogger.