পোশাকে ইসলামী মূল্যবোধ by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি লজ্জাবোধ। আর সব ধর্মের অনুসারীই এ বিষয়ে একমত যে, মানুষ তার শরীরকে প্রকাশ্যে আবৃত রাখবে। ইসলামও তাই বলে। সৌন্দর্য বৃদ্ধি, প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা, লজ্জাস্থান ঢেকে রাখা ও নিজেকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করার লক্ষ্যেই মানুষ পোশাক ব্যবহার করে থাকে।
পোশাক ব্যবহারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, 'এবং তিনি তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন পরিধেয় বস্ত্রের, যা তোমাদের তাপ থেকে রক্ষা করে।'-সূরা নাহল : ৮১
কোরআনে কারিমের অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, 'হে আদম সন্তানগণ! আমি তোমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়েছি লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভূষার জন্য।'-সূরা আরাফ : ২৬
গত ঈদে রাজধানী ঢাকার অভিজাত বিপণি বিতান থেকে শুরু করে মফস্বল এলাকার কাপড়ের দোকানগুলোতে ছিল হিন্দি সিরিয়াল ও ছবির আলোচিত নানা চরিত্রের নামে পোশাকের ছড়াছড়ি। এর মধ্যে খুশি, ঝিলিক, মানভি, পাঙঘুরি, শিলা, মুনি্ন, মাসাককালি ও সার্বিয়া ইত্যাদি বেশ বাজার পেয়েছিল। ঈদের আনন্দে আপন সন্তানকে খুশি করতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক বাব-মা সাধ্যের বাইরে থাকলেও এসব কিনে দিয়েছেন। এ পোশাকের অনেকগুলোই আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিরোধী। এসব পোশাকের কারণে ইতিমধ্যেই স্থানীয় উৎপাদকরা হারিয়েছে কাপড়ের বাজার। তাছাড়া এসব পোশাকের অনেকগুলোকেই 'মার্জিত, রুচিশীল ও ভদ্র' পোশাকও বলা যায় না। এমনিতেই আমাদের দেশে বখাটে কর্তৃক নারী উৎপাত ও নির্যাতনের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি কারণের সঙ্গে এর পেছনে যে উগ্র পোশাকের ভূমিকা রয়েছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
সম্প্রতি এ বাস্তবতারই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা ও রাজনীতিক চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। তিনি বলেছেন, তরুণীরা খোলামেলা পোশাক বর্জন করলে ইভ টিজিং কমে যাবে। তিনি ইভ টিজিং বন্ধ করার জন্য তরুণীদের শালীন পোশাক পরে বাইরে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, মেয়েদের উত্তেজক পোশাক পরার কারণে দিন দিন ইভ টিজিংয়ে পুরুষরা প্রলুব্ধ হচ্ছে। তাই পোশাক নির্বাচনের সময় নারীদের একটু সচেতন হওয়া উচিত। তার কথা নিয়ে অনেক তর্ক হয়েছে। কেননা শুধু পোশাককে দোষ দিলে অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ উপেক্ষিত থেকে যায়।
চিরঞ্জিত আরও বলেন, ইভ টিজিং নতুন কোনো ঘটনা নয়। বছরের পর বছর ধরে এই খারাপ চর্চা চলছে। কিন্তু আমাদের এটা স্বীকার করতেই হবে যে, মেয়েদের উত্তেজক পোশাক যুবক ও কম বয়সী তরুণদের প্রলুব্ধ করে। তাদের বিপথগামী হতে প্ররোচনা জোগায়। তার মতে, ইভ টিজিংয়ের মতো দুষ্ট ক্ষত সমাজ থেকে দূর করা উচিত। একই সঙ্গে নারীদের পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে সংযত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, আমরা সবাই জানি, ইভ টিজিং ভালো নয়। আমরা এর নিন্দা জানাই।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আজকাল এই সংকীর্ণতাটি প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে, কল্যাণকর কোনো বাস্তব নীতি ইসলামী নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হলে, অনেকে তা স্বীকৃতি দিতে চরম কার্পণ্য প্রদর্শন করে থাকেন। যাতে এ দ্বারা অপর ধর্মের প্রশংসা না হয়ে যায়। ভিন্নধর্মী কোনো সত্যভাষী ব্যক্তির পক্ষ থেকে বাস্তবতার এরূপ স্বীকৃতি মূলত নীতিটির বাস্তব কল্যাণকারিতাকেই স্বীকার করে নেওয়ার প্রমাণ বহন করে। সামগ্রিকভাবে সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ ধরনের মনোভাব অবশ্যই পরিহারযোগ্য।
আমাদের বিশ্বাস, ইসলামের প্রতি আস্থা থাক আর না থাক, অবাঞ্ছিত অশালীন কোনো কাজের অকল্যাণকারিতার হাত থেকে রক্ষাকল্পে যদি ইসলামের নির্দেশিত বিভিন্ন কাজের অনুসরণ করা হয়, অবিশ্বাসী হওয়াতে পারলৌকিক কল্যাণে কাজে না এলেও বৈষয়িক ও সামাজিক কল্যাণ যে ইসলামের অনুসৃত এ পদ্ধতিতে নিশ্চিত হবে_ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বর্তমানে আমাদের সমাজে প্রতিদিন যেসব অপরাধমূলক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে এবং হতাহতের ঘটনা ঘটছে, সামাজিক এই অপরাধগুলোর প্রধান কারণ হলো, ইসলামী নীতি-নৈতিকতার প্রতি প্রশাসন, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের অবজ্ঞা। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, পরকালের প্রতি আস্থা না থাকলেও ইসলামের বাস্তবভিত্তিক নীতিগুলোর প্রয়োগে আগ্রহী হলে সমাজের এই অরাজকতা নিরসনে বেশ সাফল্য অর্জিত হবে ইনশাল্লাহ।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, কতিপয় নারীর আপত্তিকর পোশাক পরিধানের নির্মম পরিণতি ও সামাজিক অবক্ষয় দেখে অন্যেরা যখন ইসলাম নির্দেশিত শালীন পোশাকের ওপর জোর দিচ্ছেন, তখন কোনো কোনো মুসলিমপ্রধান দেশের নেতৃত্ব তথাকথিত সংস্কৃতি ও চিত্তবিনোদনের নামে মিডিয়াসহ নানা উপায়ে কুরুচিপূর্ণ পোশাক-পরিচ্ছদকে প্রশ্রয় দিয়ে চলছেন, যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। এর ফলে দুষ্ট লোকগুলো অপরাধপ্রবণতার প্রতি আরও ধাবিত হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মনে করি, এখনও সমাজের সিংহভাগ মানুষ ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি আস্থাবান ও শ্রদ্ধাশীল। ইসলামী ঐতিহ্যের ধারক বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী সংস্কৃতি ও নৈতিকতা শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হলে সমাজ বিপথগামিতার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
প্রকৃতিগতভাবে যা সত্য, বাস্তব ও গ্রহণীয়_ আল্লাহতায়ালা মানুষকে তাই করার নির্দেশ দিয়েছেন। অবাস্তব, অযৌক্তিক, অপ্রাকৃতিক ও মানবপ্রকৃতি পরিপন্থী এমন কিছু করার নির্দেশ আল্লাহতায়ালা মানুষকে দেননি। বাস্তববাদী মানুষরা এ জন্যই ইসলামকে প্রকৃতির ধর্ম অভিধায় আখ্যায়িত করে গেছেন। ইসলামের পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে এটাই বিবেচ্য বিষয়। আশা করি, সমাজের বিবেকবান মানুষজন বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনে সামর্থ্য হবেন।
muftianaet@gmail.com a

No comments

Powered by Blogger.