খুলনায় আজ শুরু উৎসবের টেস্ট by উৎপল শুভ্র

দুপুরবেলায় বিরাট এক মিছিল বেরোল। সামনে শ খানেক মোটরসাইকেল। পেছনে বেশ কয়েকটা গাড়ি, যার একটি থেকে হ্যান্ডমাইকে কী সব নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। লাল-সবুজ উড়ছে অনেকের হাতে। ওই মিছিলে কিছুক্ষণের জন্য খুলনা হয়ে গেল ‘ঢাকা’! রাস্তায় যানজট।
মিছিলের পেছনে পিঁপড়ার মতো এগোচ্ছে অন্য গাড়িঘোড়া। তাতেও কারও মধ্যে বিরক্তির লেশমাত্র নেই। মনে মনে সবাই যে ওই মিছিলে শামিল!
মেয়রের উদ্যোগে ও পৌরোহিত্যে ওই মিছিল টেস্ট ভেন্যু হিসেবে ক্রিকেট ইতিহাসে নাম লেখানোর উদ্যাপন। শহর ঘুরে সেটি শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামও ছুঁয়ে এল, যেটি বিশ্বের ১০৭তম ও বাংলাদেশের সপ্তম টেস্ট ভেন্যু হিসেবে অভিষেকের অপেক্ষায়।
দৃশ্য-অদৃশ্য উৎসবের রঙে রঙিন এখন খুলনা। শহরের রাস্তায় রাস্তায় দৃশ্যমান রঙিন বাতি। স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের আবাস সিটি ইন হোটেল পর্যন্ত রাস্তায় একটু পর পরই তোরণ। সেই তোরণ অবশ্য যতটা ক্রিকেটীয়, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক, যাতে টেস্ট ভেন্যু হিসেবে খুলনার স্বীকৃতি লাভে আইসিসি ও বিসিবির ভূমিকাকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে সব কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে!
১০ হাজারের একটু বেশি স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা। কিন্তু আবহটা এমন যে, খুলনার সব মানুষই আজ স্টেডিয়ামে থাকতে চায়। প্রথম দুই দিনের টিকিট আগেই বিক্রি শেষ। তৃতীয় দিনের টিকিটের জন্যও কাল ভোররাত থেকে ব্যাংকের সামনে মানুষের দীর্ঘ লাইন। ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ তো আর সব সময় আসে না।
এই সাজ সাজ রবের মধ্যে মাঠে শেষ পর্যন্ত কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর আগেই পেয়ে গেলে তো আর খেলার মজাই থাকে না। ড্যারেন স্যামি অনুমিতভাবেই ২-০ দেখছেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ আর এই স্কোরলাইন প্রায় সমার্থকই। সর্বশেষ ব্যতিক্রম হয়েছিল এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই। গত বছর অক্টোবরে চট্টগ্রামের ড্রয়ে বৃষ্টির অবদান ছিল, তবে প্রথমবারের মতো দুবার ইনিংস ঘোষণায় যতটুকু খেলা হয়েছিল, তাতে বাংলাদেশের আধিপত্যটাও পরিষ্কার। সিরিজের প্রথম টেস্টে ভালো করলে বাংলাদেশ সাধারণত দ্বিতীয় টেস্টে আর দাঁড়াতে পারে না। সেবারও পারেনি। এখানেও বড় চ্যালেঞ্জ এটাই।
টেস্ট ক্রিকেট তো আর শুধু ক্রিকেটীয় স্কিলের পরীক্ষা নয়, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতারও ‘টেস্ট’। এখানে যেমন টানা দুই টেস্টে ভালো খেলা মানে ১৩ দিনের মধ্যে ১০ দিন টেস্ট ক্রিকেটের কঠিন পরীক্ষায় পাস করা। মুশফিকুর রহিমদের জন্য প্রশ্নপত্রটা কঠিনই।
টেস্ট ক্রিকেটের এটাও একটা মজা যে, একটা খারাপ সেশনই বাকি সব ভালোকে মিথ্যা করে দিতে পারে। ঢাকা টেস্টে যেমন দিয়েছে শেষ দিনের দ্বিতীয় সেশনটা। সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ও এই দলের ম্যানেজার রিচি রিচার্ডসন গত পরশুই বলছিলেন, প্রথম ইনিংসে দুই দলই পাঁচ শর বেশি করার পর তিনি ড্র-ই দেখতে পাচ্ছিলেন। উল্টো ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন টানা চতুর্থ জয়ের সামনে দাঁড়িয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে যে সুদিন সর্বশেষ এসেছিল প্রায় দুই দশক আগে (১৯৯৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে)।
নতুন টেস্ট ভেন্যুর উইকেট নিয়ে বাড়তি কৌতূহল থাকে। স্যামির অবশ্য চেহারা দেখে ‘ঢাকার উইকেট’ বলেই মনে হচ্ছে এটিকে। তবে এই মাঠ সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের দেওয়া তথ্য একটু অন্য রকম। শুরুতে বল ভালো ‘ভাগবে’, তবে মাটিটা এমন যে, তৃতীয় দিন থেকেই তা ভাঙতে শুরু করবে। ‘ভাগবে’র ক্রিকেটীয় অনুবাদ হলো, উইকেট গতিময় হবে। আর উইকেট ভাঙার অর্থ তখন এতে স্পিন ধরবে। এটাই যদি সত্যি হয়, তাহলে আদর্শ টেস্ট উইকেটই হতে যাচ্ছে এটি।
ঢাকা টেস্টে ওই পারফরম্যান্সের পর বাংলাদেশ দল অপরিবর্তিত রেখে দেওয়ার একটা চিন্তা খুবই স্বাভাবিক ছিল। কেউ ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় সুযোগ তো তাঁর প্রাপ্যই। সেটি অবশ্য দেওয়া হচ্ছে না জুনায়েদ ও শাহাদাতকে। শর্ট বলে হাঁচড়পাঁচড় করার সঙ্গে স্লিপে ক্যাচ ফেলাও জুনায়েদের বিপক্ষে গেছে। তাঁর জায়গা নিচ্ছেন নাজিমউদ্দিন। আর শাহাদাতের বদলে আবুল হাসানের টেস্ট অভিষেক করিয়ে দেওয়ায় কে জানে ঢাকায় অভিষিক্ত সোহাগ গাজীর সাফল্যও টিম ম্যানেজমেন্টের অবচেতন মনে কাজ করেছে কি না।
একাদশ নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুতর যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেটি অবশ্য জুনায়েদ বা শাহাদাতকে ঘিরে নয়। হাতের চোট নিয়েও তামিম ইকবাল খেলতে পারবেন কি পারবেন না, লাখ টাকার প্রশ্ন ছিল এটাই। কাল বিকেলে অনুশীলনে তামিমকেই তাই অনুসরণ করে গেল মাঠে উপস্থিত জনা চল্লিশেক সাংবাদিকের চোখ। নেটে ঘণ্টা দেড়েক ব্যাটিং করে তামিম ইকবাল সব সংশয় উড়িয়ে দিলেন। সেই উড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করলেন তিনি বল উড়িয়ে উড়িয়ে, যার কয়েকটি গিয়ে পড়ল স্টেডিয়ামের বাইরে।
তামিমকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় তাঁর বিকল্প হিসেবে কাল দুপুরে দলের সঙ্গে যোগ দেওয়া তরুণ এনামুল হক (বিজয়) ছাড়া বাকি সবাই উপভোগই করলেন তামিমের মারদাঙ্গা ব্যাটিং। টেস্টের প্রস্তুতি হিসেবে অমন ব্যাটিং বেমানান লাগতে পারে। তবে তামিম তো ব্যাটিং করতে নামেননি, নেমেছিলেন ব্যাটিংয়ের ফিটনেস টেস্ট দিতে।
উৎসবের রঙে রঙিন খুলনাকে আরও রঙিন করে দিতে বাংলাদেশের কারও কাছ থেকে বড় কিছু চাই। সেটি কি তামিমের ব্যাট থেকেই? ইংল্যান্ড মাতানো ওই সেঞ্চুরি দুটিও কিন্তু এসেছিল চোটের কারণে তাঁর খেলা নিয়ে শঙ্কার ভেলায় চড়েই।

No comments

Powered by Blogger.