ফুড়ুৎকার by নাহার মনিকা

গরর গরর আওয়াজ তোলে সসপ্যানে চায়ের পানি। আমার পায়ে ফ্লিপ-ফ্লপ, চুলার কাছে দাঁড়িয়ে হাতে বাষ্পের উষ্ণ ভাপ মাখি। আম্মা একে বলে—কুসুম কুসুম গরম। জানলার বাইরে আত্মমগ্ন তুষার ঝরে। সুখী, করুণ, শিশুতোষ, আচ্ছন্ন—যতক্ষণ না নিচে পড়ছে। পড়লেই প্রাপ্তবয়স্ক, পড়লেই নিষিদ্ধ, অচ্ছুৎ! কিন্তু দেখতে ভালোই লাগে,


অনেককাল—মনে হয় অনন্তকাল এসব তুচ্ছ, অদৈনন্দিন মহাজাগতিক ঘোরে আটকে থাকি ওই তুষারের মতো। কিন্তু ঘোর কেটে যায়, যখন মাথায় নরসিংদীর রাস্তাঘাট এসে ঘাই মারে। নিমফুল, দাগলাগা পানির গেলাস। স্কুলের জংধরা নিঃসঙ্গ টিউবওয়েল। আব্বার সরকারি অফিসের মনমরা সিঁড়ি। ওখানকার স্থাবর-অস্থাবর—সবকিছুর বিনিময়ে এখন এই কুইবেকে আমাদের পরিযায়ী দিনরাত!
অনু দরজাটা ভালোমতো বন্ধ করেনি। আর আমি দেশে থাকতে তালা বন্ধ করার অভ্যাস ভুলতে পারি না, প্রথমে কলাপসিবল গেট, সেখানে বড় তালা, ঘটাং। তারপর ভেতরের ছোট গেটে আরেকটা তালা, সামান্য ঘটাং। ঘষায় ঘষায় সাদা হয়ে যাওয়া ঘরের কপাটের সোনালি কড়ায় তালা, কোনো ঘটাং নেই। অনুর মন থেকে চুরি-চামরির ভয়ডর উড়ে গেছে, দরজা তো অদরকারি, জামা-জ্যাকেটের বোতামেরই খেয়াল নেই!
আম্মা বাসায় থাকলে সকালের চা আমারমতো ৩০ বছরের মেয়েকেও করতে দেয় না। ১৫ বছর হয়ে গেল মন্ট্রিয়াল শহরে, তা-ও নিজের হাতে পাতা ফুটিয়ে ঘন চা খাবে আম্মা। টুকটুকিও নাকি ভালোবেসে খায় এই ঘন দুধেল চা। ওকে কথাবার্তার পর্যায়ে নিয়ে আসতে আম্মার ঝাড়া আট বছর লাগল। এই আট বছরে—দুই হাত উঁচু করে আম্মা যখন উঁচু শেলফের বইপত্র ঝাড়ে-টাড়ে, দেখতে পাই তার চামড়া হাড়-মাংস থেকে সামান্য দূরত্ব বাড়িয়েছে। সেই স্পেসে আট সংখ্যাটা সেঁটে বসে গেছে আংটার মতো। তাই নাকি যায়, ইমারতের গাঁথুনি যেমন ভূমির অন্তর্গত কম্পনে খুলে খুলে শিথিল। কুইবেক সিটিতে থাকা ফরাসি বলা টুকটুকির চোখ নাকি খুব বাঙ্ময়—আম্মার ভাষ্য। ও আমাদের কথা বোঝে না। ইংরেজিও ভালো পারে না। তবে একদিন তুষার পড়া দেখে যখন হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে ইংরেজিতে বলে ওঠে—‘দেখ দেখ, আকাশ হইতে দেবতারা কেমন অশ্রুপাত করিতেছে’—সঙ্গে সঙ্গে আম্মার কালি পড়া চোখে অচেনা বিস্ময়, উঠে আসার ভঙ্গীতে এক দাগ ওষুধের মতো হালকা উচ্ছ্বাস যোগ হয়, যেন একটা পাখি—মুহূর্তে গোলাপি ফ্লেমিঙ্গো।
অনু খুব বিরক্ত, টুকটুকি-সংক্রান্ত যেকোনো কথা তিতকুটে লাগে ওর। ওকে কেউ কিছু বলতেও পারে না। টনটনে জেদি ষাঁড়ের মতো কথার শিং তেড়ে আসার ভয় করে সবাই। তার ওপর অনু ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে বায়োলজি পড়ে নিজের খরচে। যেনতেন মজদুরি না, রীতিমতো টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ করে। যতই ও আইশ্যাডো লাগানো শুরু করুক না কেন অথবা ফেসবুক টুইটারে জানবাজি রেখে পড়ে থাকুক, কে কী বলবে?
টুকটুকির মাথাটা নাকি একদম জাংক বাক্স। আর আম্মাও পারে, সারাক্ষণ ওর আগের বাড়ি, আগের বন্ধুরা, মলের ভিড়, খলবল-বকবকের মধ্যে নিজের ছোটবেলার হজমিওয়ালা, চালতার আচার আর ছি-বুড়ির গল্পের চিৎকার গুঁজে দিয়ে দিয়ে ঘণ্টি বাজায়। স্কুলের সামনের, এমনকি আচার ওয়ালটার কাঁচাপাকা গোঁফটাকেও এঁকে দেয়, যাতে সে টুকটুকির স্বপ্নে এসে ধরা দেয়।
চায়ের কাপ নিয়ে দরজায় নক করি। এ ঘরটা ভাপসা, মানুষ বসবাসের সহজাত গন্ধ হারিয়ে গিয়ে অস্বাভাবিক কিছু, জানালার বাইরে গাছের পাতায় আলো পড়ে বৈদূর্য্যমণির মতো ফুটে থাকা বরফ থোকার দিকে তাকালে সে গন্ধ বড় বেমানান। জানলা খুলে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দিই না। টুকটুকির লেপটা ভাঁজ করাই থাকে। পায়ের দিকে লম্বা বালিশ দঙ্গল করে পাকানো। ওর ঘোর কৈশোরের শেষ স্টেশন। তাই বলে ঘুম ভাঙা কণ্ঠ এত বাজখাই শোনাবে? নাকি আমার কল্পনা!
—নোওওপ, আই ডোন্ ওয়ান্ট!...
ওর ডেস্কের ওপর রাজ্যের স্টিকার সাঁটা, একের পর এক, একটার ওপর আরেকটা, হিজিবিজি, ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া জটিল এক কোলাজ। সদরঘাটের কথা মনে পড়ে, যেন খুব ভোরে ঝালকাঠির লঞ্চ ভিড়ছে, বুড়িগঙ্গার ওপারে কোটি মানুষের প্রত্যুষস্নান, একই রকম, হিজিবিজি কোলাজ। এই ভিড়ে আপন দুই মুখ, আম্মা আর আব্বা।
এই মন্ট্রিয়াল শহরে এসে জোটার আগে আব্বার একটা যুক্তিই সারাক্ষণ টিভির সংবাদের মতো পুনরাবৃত্তি হতো—‘আমাকে না, দেশের ৯০ পার্সেন্ট মানুষ ডেকে জানতে চাও, সবাই এক পা বাইরে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তোমাদের এখানে ভালো লাগে না! ইয়ার্কি মারবে না আমার সঙ্গে!’ কানাডায় থাকার জন্য রিফ্যুজি ক্লেইমের প্রাণান্ত চেষ্টাকে একটুও অস্বাভাবিক লাগেনি কখনো!
আম্মা কাঁদে, আম্মা কী বিচিত্র কারণে জানি ফেসবুক, ইন্টারনেট—এসবে আগ্রহবোধ করে না, বাঙালি গ্রোসারির ক্যালেন্ডারে ছাপা হওয়া সরষেখেতের ছবি দেখে বর্ষকালের মতো কাঁদে শুধু। এখানকার ন্যাতানো চুপচাপ পরিবেশে কান্না একদম ভালো লাগে না। আম্মা কাঁদলে আমি বা অনু কেউ কখনো কোনো সান্ত্বনা দিই না। কালেভদ্রে অনু গাদা স্টিকার কিনে এনে রাখে। আম্মা তখন কান্না থামিয়ে সেগুলো নিয়ে পড়ে।
চায়ের সঙ্গে ফ্রি বাংলা ট্যাবলয়েড জমে ভালো। এর পেটের মধ্যে গাদাগাদি করে তাবৎ দুনিয়ার বিজ্ঞাপন। বড়সড় রুই মাছ প্রায় কোলে করে গ্রোসারির ভেতরে রশিদ মিয়া, দুই পাশে সারি সারি শেলফে দেশি ব্র্যান্ডের মসলাপাতি, গত রোজায় বিশাল ইফতার পার্টির হোস্ট। আমরা রোজায়ও নাই, পূজায়ও নাই, না-কুড়োনো পাতার মতো উড়ে আসি, টুক করে এলিয়ে তারপর আবার উড়ে যাই... আমাদের আব্বা-আম্মা আসলে গসিপের জ্বালানি ছাড়া তেমন আমলে আনার মতো কেউ নয়। রিয়া ভাবির ভ্রু প্লাকের মূল্যহ্রাস একজোড়া বাঁকানো ভ্রুকে তৃতীয়ার চাঁদ বানিয়ে কোনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অনু বাঙালি দোকানপাটে ঢোকে না। আমাকেও নিয়ে যায় বাঙালিপাড়া ছাড়িয়ে দূরে এক ভিয়েতনামের মেয়ের কাছে। আমরা মদিনা বানু ঝুমার সুলভ কেটারিং—শামি কাবাব আর ছানার জিলেপির স্বাদ-গন্ধওয়ালা বাতাস পার হয়ে যাই। শীতকালে কম, গরমকালে ভুরভুরে সুঘ্রাণ, ক্ষুধা উদ্রেককারী।
আব্বা ছানার জিলেপি পছন্দ করে খায়, শুধু পছন্দ বললে বড় সাদামাটা শোনায়, বিকারগ্রস্তভাবে পছন্দ। আম্মা নাকি সে জন্য না হলেও শ খানেক লিটার দুধ ক্ষয় করেছে। এই মিষ্টি বড় আজব, কিছুতেই মন বসিয়ে স্থির হবে না। একদিন বিটকেলে শক্ত, একদিন ফুলবেই না। অন্যদিন ফুলল, রংটাও জাঁহাবাজ—আম্মা খুশি মনে ঘুমোতে গেল। সকালে উঠে দেখা গেল, তেনারা সব চেপ্টে নেতিয়ে গেছেন। দৈবক্রমে দু-একবার শিকে ছিঁড়ে আসলি স্বাদ আর চেহারা দেখা গেলে আব্বা ঘোষণা দিয়ে দেয়, বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিজের বাসায় ছানার জিলেপি খেয়ে তার জীবন সার্থক। অঋণী, অপ্রবাসী নিজগৃহে শাকান্ন ভোজনকারী সুখী মানুষের সংজ্ঞা—ব্যস উলটে গেল!
সেগুলো কি সুখের দিন?
বাংলা ট্যাবলয়েডের বিজ্ঞাপন পাতায় ছাপা এই লোকাল মুখগুলো সব চেনা। আমাদের চৌকোনা বাসার খানাখন্দের অন্তঃস্থল চষে ফেলতে ফেলতে আমার এদের গল্পগুলোও বের করতে ইচ্ছে করে। ব্লাউজ বানাত মিনারা পারভীন, ট্রেইন্ড বাই অভিজ্ঞ টেইলার্স ইন মৌচাক মার্কেট, এক হাতের তিন আঙুল ঢাকা শহরের গার্মেন্টসে দুর্ঘটনায় কাটা পড়েছে। সস্তায় মন্ট্রিয়াল টরন্টো ট্রিপ-প্লাইমাউথ ভয়েজার ভ্যানের সামনে মোহাম্মদ আলী মিয়ার রাঙানো দাড়ি, নির্ঘাত মধ্যপ্রাচ্যের ধু ধু হাইওয়েতে গাড়ি চালানো হাসি মুখ। কী করে জানি আমি? আসলে জানি না, বিজ্ঞাপনের পেছনের গল্পগুলো খুঁজে বেড়াই। যদিও সব সময় যে পাই তা নয়, কিন্তু আছে। থাকতেই হবে। তুচ্ছ হোক, তস্য তুচ্ছ হোক, গল্প না থেকে পারেই না।

২.
আজকে আব্বার সঙ্গে দেখা করার দিন। মাসে দুদিন আমার টার্ন। অন্য দুহপ্তা অনু। আম্মা সব সময় বলবে—টুকটুকিকে নিয়ে যা। আব্বার ভ্রমণ কেবল দুটো জায়গায়, ক্রাইসিস সেন্টার থেকে সেন্ট্রাল জেলে, জেল থেকে দরকার পড়লে আবার ক্রাইসিস সেন্টারে। সোশ্যাল সার্ভিস থেকে ফোন করে প্রায় সময় আগেই জানিয়ে দেয়। আগে কেউ দেখা করতে যেত না। ফ্রাঁসোয়া যোগাযোগ করার পর থেকে শুরু। দু-একবার আব্বা খুব ধোপদুরস্ত, দুএকবার জীবনের যাবতীয় দায় কাঁধে চাপানো পতনমুখী স্থবির।
তা-ও ভালো। দুই বছর আগে পুলিশের বিশেষ অধ্যাদেশ অনুযায়ী আব্বার তো এই বাসার ২০০ গজের মধ্যে ঢোকা বারণ ছিল। দেখলে পুলিশ ডাকা যেত। আব্বা কয়েকবার সামনের বাস স্টপে এসে বসে থেকেছে। আমরা জানলার পর্দা একটু তুলে দেখেছি। আম্মার মনে হতো টুকটুকি লাফিয়ে উঠে দৌড়ে বাইরে যেতে পারে, লো ভল্যুমে ওর প্রিয় ট্রি-হাউস চ্যানেল চালিয়ে দিলে জেলাটিনের মতো জমে যাবে। তারপর নির্বিকারে ঘরের কাজ সারত। আমি ঘরের ভেতর গিয়ে চেয়ার টেনে পর্দার ওপরের ঘুলঘুলি দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম রাস্তায়। আব্বার পরনের প্যান্ট হাঁটুর কাছে অল্প দুমড়ানো। ঘোলা চোখ যেন বাসের অপেক্ষায়, কিন্তু বাস এল, গেল, আব্বা নড়ল না। বাসস্ট্যান্ডের পাশে লাইলাকগাছটার মতো স্থির থাকল, ছোট্ট গাছ, ফুল ঝরছে।
চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেলে নেমে আসতাম, পায়ের অবশ ভাব ভালো হয়ে গেলে আবারও চেয়ারে উঠে দেখতাম, আব্বা চলে গেছে!

৩.
লিওনেল গ্রু আন্ডার গ্রাউন্ড রেলওয়ে জাংশন, নাততেই ফ্রাঁসোয়া, দুই হাতে কাগজের কাপ। কফি। হাইতিতে এরা এত ফ্রেঞ্চ নামও রাখত, বাব্বা। আমি হাসি— ‘আমার দেশে নামে আ-কার থাকলে কেমন মেয়ে মেয়ে শোনায়।’ ফ্রাঁসোয়াও হাসে, বলে, ‘তোমার নামটি কিন্তু আমার পছন্দ হইয়াছে। বেশ করিয়া র‌্যাগে মিউজিকে চালাইয়া দেওয়া যায়।’
ফ্রাঁসোয়াকে দেখলে মনে হয়, মূর্তিমান আত্মবিশ্বাস সম্বল করে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ একটু বাদেই বোঝা যায়, সে স্বভাবে অস্থির। সোশ্যাল ওয়ার্কার বলেই হয়তো একটা প্রফেশনাল মুখোশ। আব্বা কি আর ওর একলা কেস? কত ধরনের বৈচিত্র্য ঘিরে দিনাতিপাত করে এরা! এই ছেলের ওপর নির্ভর করতে ভালো লাগে। বলেও ফেলতে চেয়েছি, ‘আমাকে বিবাহ করিয়া ফেলো।’ ফ্রাঁসোয়া একটি ঘুষি বাগিয়ে আসবে ভেবে পেটে চালান করে দিয়েছি বাক্যটাকে।
অনু যেমন বলে, ‘ইউ ল্যাক সেলফ কনফিডেন্স, লাইক মোস্ট অব দ্য বাংলাদেশিস।’ আমার খুব রাগ হয়, কিন্তু এটা তো সত্যি যে রাস্তা হারালে আমার প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজনকে থামিয়ে পথের দিশা জানতে ইচ্ছে করে। ফ্রাঁসোয়া কফি কেনে যে দোকানে, একই ঠিকানা জানতে পরপর না হোক তিন দিন গেছি। কানে ব্লু টুথ, আরেক কানে দুল ঝোলানো ছেলেটার শঙ্খসাদা দাঁত আর কালো ঝকঝকে চেহারা আপন লাগত! তিন দিনের দিন সে হেসে ফেলেছে, ‘মাদমোয়াজেল, তুমি বোধ করি শহরে নতুন আসিয়াছ।’ অপ্রস্তুতের হাসি সপ্রতিভ হয়ে দেখাই, ওকে বলে কীভাবে যে ১৫ শীত পার হয়ে গেল এখানে!
ক্রাইসসিস সেন্টারের ওয়ার্কারগুলো এমন সন্ধিগ্ধ হয়ে তাকায়, যেন আমিও ওদের ইন-হাউস রোগী, চাউনির ছাঁকনিতে আমার ভাবনা ছেঁকে ফেলবে মুহূর্তে। এদের কারও কাছেই টুকটুকিকে ফস্টার হোমে দিয়ে দেওয়া অস্বাভাবিক লাগে না। মা-বাবা বায়োলজিক্যাল হলেও যদি ঠিকঠাক লালন-পালনের দায়িত্ব নিতে না পারে, তাহলে সরকার আছে—এ রকম করেই তাদের চিন্তার বিন্যাস।
আব্বা প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল একটা ভদ্র চাকরি জোগাড় করতে। সবাই শুধু পরামর্শ দিত—ফরাসি ভাষা শেখো। ভাষা শেখা কি সবার কাজ? আম্মা টুকটুকিকে নিয়ে আবার গর্ভবতী, তখন এই নেই নেই করে তিন বছর পার হয়ে গেছে। তাদের রিফ্যুজি ক্লেইম ঝুলে আছে কী কারণে, কেউ বলতে পারছে না। ইমিগ্রেশন কানাডা আরেক ছানার জিলেপির মতো, মুড সুইংয়ে ভোগে। ফোন করলে যন্ত্রস্থ কণ্ঠস্বরে ধাতব উত্তর। বছরের পর বছর ফাইলবন্দী হয়ে থাকার উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষা।
আম্মার বেশি বয়সের গর্ভাবস্থা, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারে চলার মতো টাকা সরকার দেয়, কিন্তু আব্বার নাকি খুব মানে লাগে কাজ না করে পয়সা নিতে। অন্য সবাই যখন নানা ফন্দিফিকির বের করে আর নিজেরা ক্যাশ টাকায় রেস্টুরেন্টে কাজ করে দেশে প্লট কেনে, আব্বা তখন কেবলই বিষণ্নতায় ভোগে। আম্মাকে না জনিয়েই টুকটুকিকে ব্যাতশো অ্যাডাপ্টেশন সেন্টারে জন্মের আগেই দত্তক দেওয়ার লিস্টে নাম লিখিয়ে এল। না জানিয়ে তো আর হয় না, এক দিনেও না। আম্মা বলে যে তাকে প্রেসার করেছিল, স্যুটকেসে অতিরিক্ত কাপড় ভরে চাপলে যেমন সেই রকমের। দিনের পর দিন সোশ্যাল ওয়ার্কারের প্রশ্নোত্তর, আম্মার গর্ভাবস্থার রিপোর্টের সব ফটোকপি, বাচ্চাটাকে সুস্থ-সবল প্রসব করাচ্ছে কি না ইত্যাদি হচ্ছিল সেকি আর আম্মাকে না জানিয়ে? ফ্রাঁসোয়া আমার কথায় এই প্রশ্ন করবেই করবে—‘কেন না ইহা তোমাদের সংস্কৃতির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে।’ এই রকম কথাবার্তার শুনে বাসায় ফিরে আমি কিছুক্ষণ আম্মাকে সন্ধিগ্ধ চোখে দেখি।
টুকটুকির জন্মের পর হাসপাতালে সোশ্যাল ওয়ার্কার হাজির। তার সঙ্গে লাজুক উচ্ছ্বাসে দত্তক নিতে ইচ্ছুক দম্পতি। আম্মার বিস্ময়, শোক, স্থাণু অবয়ব আর থরথর করে কাঁপা শরীরের সামনে তারা তার সই করা কাগজ মেলে ধরল। আম্মা কাগজে বসানো তার নিজের সইটা ছুঁয়ে দেখার ব্যাকুল চেষ্টা করে। তার আঙুলে একটু আগে টুকটুকির গাল স্পর্শ করার কোমল মায়া। বুকের দুধ খাওয়াতে হয়নি, কেন যেন হচ্ছে না। নার্সরা ফর্মুলা মিল্ক খাইয়ে দিয়েছে।
নিউবর্ন বেবি ছাড়া আম্মা খুব স্বাভাবিকভাবে বাড়ি ফিরে আসে, আব্বা তখন আমার বিয়ের পাত্র দেখে বেড়াচ্ছে, মরিয়া হয়ে, খ্যাপাটে হয়ে। অন্তত আমার যদি কোনো হিল্লে করে যেতে পারে; কিন্তু ডিপোর্টেশন নোটিশ পাওয়া পরিবারের সঙ্গে এখানে কে আত্মীয়তা করবে! গ্রোসারির দোকানের মাংস কাটার লোকটারও কানাডিয়ান পাসপোর্ট আছে! আব্বা কারণে-অকারণে বাঙালি গ্রোসারিতে গিয়ে আড্ডা দেয়। আাাকে যুক্তিবিদ্ধ করতে একদিন ডাইনিং টেবিলের চেয়ারটা ভেঙে ফেলল। আম্মা তখন তার ঘরের কোণে টুকটুকির বিছানা ঠিক করছিল, এর কোনো দরকার নেই, তা-ও রুটিন বানিয়ে করে। শাড়ি ছিঁড়ে অপ্রয়োজনীয় কাঁথা বানায়।
লোকাল অ্যাডাপ্টশন, বিশেষ করে একই প্রদেশের মধ্যে হলে নাকি ফেরত পাওয়ার উপায় আছে। আম্মা তাই নিয়ে সারা দিন ফোনে ব্যস্ত থাকে। চেয়ার ভাঙা শেষ করে আব্বা যখন ছুরি-কাঁচির খোঁজ করছে, আম্মা তখন এক দৌড়ে নাইন ওয়ান ওয়ান কল করে দিল!
ঘরের মধ্যে দণ্ডায়মান নারী-পুরুষ উভয় পুলিশকেই আমি সেদিন ভয় পেয়েছিলাম, বরফকুচি যেমন করে উত্তাপ ভয় পায়। ওদের হাত শক্ত হয়ে দেহের দুই পাশে দোলে, ছন্দহীন। ওরা আব্বাকে নিয়ে গেল, আর আমরা মা-মেয়ে উইমেন শেল্টারে উঠে এলাম। অণু তখনো স্কুল থেকে ফেরেনি।

৪.
আম্মা এসে দরজার কাছে দাঁড়ায়। আমি জ্যাকেট ও বুটজুতা দরজার পাশে রাখি। আম্মার ম্যাক্সিতে চায়ের দাগ। অনেক বর্ষণক্লান্ত খড়ের চালার মতো তার চোখের পাতা ভারী। কী বলবে আমি জানি, একই সংলাপ, রিপিট বাটন প্রেস করা আছে।
—টুকটুকি কিছুতেই এই চা খায় না।
—জোর করো ক্যান, না খাইলে না খাবে।
—মেয়েটা মইরা যাবে তো!
—না আম্মা, মরবে না। চা না খাইলে মানুষ মরে না।
—না, যা, আরেকবার দ্যাখ। এই মেয়ে দিন দিন ধাড়ি হচ্ছে, ঘরের কাজ-কামে একটু হাত লাগায় না।
আম্মার গলার কাছে বিরক্তি হিল হিল করে। আর আমি টুকটুকিকে কল্পনায় দেখি, সে ধুপধাপ বের হয়ে যাচ্ছে, হাইহিল বুট, তীব্র পারফিউম, নকল নখে নীল রঙের নেইল পলিশ। টুকটুকি মেট্রো স্টেশনের বাইরে চায়নিজ পাংক ছোকরার কাছ থেকে পট কিনছে...ওর ঘরভর্তি ধোঁয়া। ওকে যারা দত্তক নিয়েছিল, সে মহিলা কিছুটা এমনই দেখতে ছিল!

No comments

Powered by Blogger.