ঘুম কেড়ে নেওয়া রাত

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পরপরই শোবিজ জগতে নেমে আসে শোকের ছায়া। বন্ধ হয়ে যায় নাটক-চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ। অনেকেই ভেঙে পড়েন কান্নায়। তাঁরা কালের কণ্ঠের কাছে জানান তাঁদের অনুভূতি।
আমি একটা অপরাধ বোধে ভুগছি- মকসুদ জামিল মিন্টু [সুরকার ও সংগীত পরিচালক] : 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। এরপর হুমায়ূন আহমেদের প্রায় ৯০ ভাগ নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আমি করেছি। সংখ্যা হিসাব করলে তা দুই শ-রও বেশি হবে। 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'দুই দুয়ারি', 'চন্দ্রকথা' এবং সর্বশেষ 'ঘেটুপুত্র কমলা' ছবির সংগীত পরিচালনা করেছি। কখনোই তিনি গানের সুর শুনতেন না। বলতেন, আপনার কাজ আপনিই ভালো বোঝেন। তবে রেকর্ডিংয়ের সময় ঠিক উপস্থিত থাকতেন। বলতেন, 'গানে গুড জব, আল্লাহ ভরসা।' কিন্তু এই মুহূর্তে আমি একটা অপরাধ বোধে ভুগছি, কারণ তিনি যখন দেশে এসেছিলেন ব্যক্তিগত কারণে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। এমনকি 'ঘেটুপুত্র কমলা'র প্রিমিয়ারেও হাজির হতে পারিনি। শুনেছি, মঞ্চে উঠে তিনি আমাকে খুঁজেছেন, আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি তিনি এভাবে চলে যাবেন। কখনো ভাবতেই পারিনি এমনটি হবে।

আজ রাতে আর ঘুমোতে পারব না
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় [অভিনেতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিএফডিসি]
তিন-চার দিন ধরেই খবর পাচ্ছিলাম তাঁর অবস্থা ভালো নয়। আজ সারা দিন শুনছিলাম তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঘুমোতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় সংবাদটা শুনলাম, আজ সারা রাত আর ঘুম হবে না। হুমায়ূন আহমেদ বয়সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড়, তবু তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। স্বাধীনতার আগে ও পরে তাঁর সঙ্গে আমার এতটা স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে, বলতে বলতে রাত পেরিয়ে যাবে। তাঁর এই প্রয়াণে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এক অমূল্য রতন হারাল। এই মুহূর্তে এই বেদনার্ত হৃদয়ে কথা বলার ভাষাই তো থাকে না। সৃষ্টিকর্তা তাঁর মঙ্গল করুন।

এখন কিছুই বলতে পারব না, প্লিজ
মাহফুজ আহমেদ [অভিনেতা]
আমি এখন কিছুই বলতে পারব না। প্লিজ, এই বিষয়ে পরে কথা বলব। ওনার সঙ্গে আমার অনেক কথা ছিল, আছে। আমি পরে বলব। এখন কিছুই বলতে পারব না। প্লিজ, দোহাই আপনাদের। এখন আমি... পরে কথা হবে...

স্যার আমাকে জীবনবোধ শিখিয়েছেন
রিয়াজ [অভিনেতা]
এই মুহূর্তটা আসলে কথা বলার না। আমার কথা আসছে না। আমার কেবলই কান্না পাচ্ছে। তা ছাড়া হুমায়ূন স্যারকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। সারা দেশের মানুষ তাঁর সম্পর্কে জানে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই বিশাল মানুষটার সঙ্গে কাজ করার। এ জন্য আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। গতানুগতিক সিনেমায় অভিনয় করে আমি বিশাল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলাম। কিন্তু হুমায়ূন স্যার আমাকে উচ্চবিত্তের ধরাছোঁয়ার মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। ২০০০ সালে স্যারের পরিচালনায় 'দুই দুয়ারী' ছবিটি আমার ক্যারিয়ারের এক ভিন্ন অধ্যায়। ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'শ্যামল ছায়া' ছবিতে তিনি আমাকে একজন মাওলানার চরিত্রে অভিনয় করিয়েছেন। আমি নাটকে সাধারণত অভিনয় করি না। কিন্তু স্যারের সংস্পর্শে থাকতে পারব, এই ভেবে আমি তাঁর অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। আর কোনো দিন এই মানুষটার হাসি মুখ দেখতে পাব না- এই কথাটা ভাবলেই আমি অসহায় বোধ করি।

ও আমার উড়ালপঙ্খী রে...
ফেরদৌস [অভিনেতা]
হুমায়ূন আহমেদ আর নেই- এই কথাটা আমি আজকে যেমন বিশ্বাস করছি না, কোনো দিনও করব না। স্যার বেঁচে থাকবেন তাঁর অসামান্য লেখনীতে, তাঁর সৃষ্ট চলচ্চিত্রের মাঝে। তাঁর দেহত্যাগের কথা শুনে অনেকক্ষণ আমি কোনো কথা বলতে পারিনি। চোখ বেয়ে অনবরত পানি ঝরেছে। ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'চন্দ্রকথা' ছবিতে অভিনয়ের সময় স্যারের সঙ্গে প্রথম আমার মেশার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর ইউনিটে আমি যত দিন কাজ করেছি, আমার মনে হয় তত দিন আমি অন্য এক গ্রহে ছিলাম। এই পৃথিবীতে এমন মানুষ দ্বিতীয় আরেকটি আমি খুঁজে পাইনি। অভিনয়ের খুব সূক্ষ্ম কিছু বিষয় স্যার আমাকে শিখিয়েছেন। এরপর যত ছবিতেই অভিনয় করেছি, তাঁর এই শিক্ষা আমার কাজে লেগেছে। চন্দ্রকথা ছবির একটি গানের কথা আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, 'ও আমার উড়ালপঙ্খী রে, যা যা তুই উড়াল দিয়া যা।' স্যারের লেখা এই গানে আমি ঠোঁট মিলিয়েছিলাম। হুমায়ূন স্যার আমাদের কাছ থেকে উড়াল দিয়ে যেতে পারেন না। কক্ষনোই না! তিনি সব সময় আমাদের পাশেই থাকবেন।

আমার অভিনয়জীবনের শুরুটাই তো তাঁর হাত ধরে
বিদ্যা সিনহা মিম [অভিনেত্রী]
আমি এই মাত্র শুনেছি হুমায়ূন আহমেদ স্যার চলে গেছেন। খবরটা শুনে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলাম। বিশ্বাস করতে পারছি না। তাঁর সঙ্গে এত কাজ করেছি- চলচ্চিত্রে, নাটকে। আমার অভিনয় জীবনের শুরুটাই তো তাঁর হাত ধরে। তাঁর চলচ্চিত্র দিয়ে আমি অভিনয় শুরু করেছি, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছি। এরপর তাঁর আরো অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। তিনি প্রতিটা মুহূর্তে এত যত্ন নিয়েছেন, এত আদর করেছেন- বলার মতো না। এই মুহূর্তে আমার একটাই চাওয়া, তিনি যেন স্বর্গবাসী হন, যেখানেই থাকুন অনেক ভালো থাকুন।

আর কাজ করতে পারছি না
আহমেদ রুবেল [অভিনেতা]
শুটিং করছিলাম উত্তরায়। আমার সঙ্গে বিজরীসহ আরো অনেকেই আছেন। শুটিংয়ের ফাঁকে আমরা কথা বলছিলাম হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে, তাঁর লেখা, তাঁর চলচ্চিত্র, তাঁর নাটক সর্বোপরি মানুষ হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। এমনই সময় এমন একটা সংবাদ আমাদের থমকে দিয়েছে। হতভম্ব হয়ে গেলাম। আর কাজ করতে পারছি না, এমন কেন হলো?

অভিনেতা ফারুক আহমেদকে জন্ম দিয়েছেন তিনি
ফারুক আহমেদ [অভিনেতা]
অভিনেতা ফারুক আহমেদের জন্মই তো হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে। আমি ফারুক আহমেদকে মানুষ চেনে হুমায়ূন আহমেদের সুবাদে। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে জন্ম দিয়েছেন তিনি। তাঁর কাছে আমার যে কত ঋণ, তা শোধ করার সাধ্য নেই। আজ এই সময়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার ভাষা কিংবা সাধ্য আমার নেই।

তিনি আমাকে দেশে এনেছেন, অভিনেতা বানিয়েছেন, এখন তিনিই চলে গেলেন!
স্বাধীন খসরু [অভিনেতা]
আমি তো লন্ডনে থাকতাম। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে দেশে এনেছেন। বিয়ে দিয়েছেন, অভিনেতা বানিয়েছেন। আর এখন তিনিই আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। এর চেয়ে বেদনার, কষ্টের আর কী হতে পারে! আমার সবচেয়ে বড় অভিভাবককে হারিয়ে ফেললাম! যার কারণে দেশে আসা, তিনিই যখন নেই, আর এখানে থেকে কী হবে, কিভাবে থাকব এই দেশে! আমি কি তবে ফিরে যাব লন্ডনে? কার কাছে জানতে চাইব? যার উপদেশ, পরামর্শ নিয়ে এত দূর এসেছি, তিনিই তো আর নেই।

পরিকল্পনা করেছিলাম তাঁর লেখা নাটক করার
ডি এ তায়েব [অভিনেতা]
হুমায়ূন আহমেদের মতো এমন বড় মাপের মানুষ হয় না। বাংলা সাহিত্যে তো বটেই, বাংলা নাটকে এমনকি চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান কোনো দিন ভোলার নয়। কিছুদিন আগেই পরিকল্পনা করেছিলাম, তাঁর লেখা নাটক করার। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার সেটা আর হলো না।

স্যার কিছু কী হয়েছে? কিছু কী পেরেছি?
মাসুদ আখন্দ [অভিনেতা ও পরিচালক]
হুমায়ুন আহমেদ আমার বাবার সমান। তাঁকে দেখেই আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করি। তিনি বলেছিলেন, 'এভাবে হবে না।' আমি চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করলাম, সুইডেন ছেড়ে দেশে এলাম, তাঁর মতো একজন মানুষের সঙ্গে কাজ করলাম। তাঁর স্নেহ, ভালোবাসা পেলাম। এটা যে কত বড় সৌভাগ্যের বলে বোঝাতে পারব না। এখন আমি আবারও সু্ইডেনে। দেশে ফেরার কথা, স্যারের সঙ্গে বসার কথা। আমার নির্মিত চলচ্চিত্রটি রিলিজ দেওয়ার কথা। অথচ স্যার চলে গেলেন। জানি পারিনি, তবু জানতে ইচ্ছে করছে, স্যার, কিছু কি হয়েছে? কিছু কি পেরেছি? মাথার ওপর আপনার আশীর্বাদের ছোঁয়া এখনো টের পাচ্ছি।

বাবাকে হারালাম, একমাত্র অভিভাবককে হারালাম
জুয়েল রানা [হুমায়ূন আহমেদের সহকারী পরিচালক]
কিছু বলতে পারছি না, পারব না। যা হারিয়েছি, যাকে হারিয়েছি, কোনো দিনও ফিরে পাব না। বাবাকে হারালাম, একমাত্র অভিভাবককে হারালাম। স্যারের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কতবার অভিমান করেছি। অথচ তাঁর মতো একজন মানুষ আমাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে বলেছেন, কী লাগবে বলো। আমি ভুল করেছি, তিনি রাগ করেননি। ভালোবাসা দিয়েছেন, স্নেহ দিয়েছেন। বাবার মতো ছায়া হয়ে পাশে থেকেছেন। তার স্নেহেই তো বেড়ে উঠেছি। এখন আমকে কে আগলে রাখবে বাবার মতো?

অনুলিখন : এম এস রানা, দাউদ হোসাইন রনি, কাজী গোলাম রাব্বানী, রবিউল ইসলাম জীবন

No comments

Powered by Blogger.