না নিষাদ by বেলাল চৌধুরী

বাপের বেটাই বলতে হবে। আমাদের সময়ের কিংবদন্তিকে অনেক দূর ছাড়িয়ে যাওয়া- দেখতে ছোট হলে হবে কী, আমাদের দুঃসাহসী এই লেখকটি, আমি হুমায়ূন আহমেদের কথাই বলছি; যিনি জীবৎকালেই হয়ে উঠেছিলেন প্রবলভাবে বিশ্বাসী এক স্রষ্টা, ইচ্ছামাফিক যা খুশি তাই করতে পারতেন। শুধু পারতেন বললে কমই বলা হবে,


পেরেছেন যে সেটা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যে বিপুল বিশাল সৃষ্টি রেখে গেলেন, তাই নিয়ে আমরা সমসাময়িকরা তো বটেই পরবর্তী সময়ে আরো কয়েক প্রজন্ম সেই অগাধ ঐশ্বর্য অতল স্পর্শ অবধি ডুব মেরেও অতুল বিভার খোঁজ পাওয়া কী সম্ভব হবে?
সীমা শব্দটার সঙ্গে একটা না লাগিয়ে দিয়ে আমরা অসীম শব্দটাকে রচনা করে সেই শব্দটাকে শূন্য করে বৃথা ভাবতে চেষ্টা করি, অসীম তো না নয়, তিনিকে নিবিড় নিরবচ্ছিন্ন হ্যাঁ। সার্ধশত বছরে এসেও রবীন্দ্রনাথে প্রগাঢ়ভাবে নিবেদিত ছিলেন হুমায়ূন। এই তো সেই দিন মরণব্যাধি আক্রান্ত হওয়ার পরও মৃত্যুচিন্তা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন প্রিয় কবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে, মৃত্যুকেই আমরা সকলের চেয়ে ভুলে থাকি, অথচ মৃত্যু যখন ঘরের মধ্যে দেখা দেয় তখন বোঝা যায় মানুষ কত অসহায়। 'যদি মৃত্যু না থাকিত জগতের যেখানকার যাহা তাহা চিরকাল সেখানেই যদিও অবিকৃতভাবে দাঁড়িয়ে থাকিত, তবে জগৎটা একটি চিরস্থায়ী সমাধি মন্দিরের মতো অত্যন্ত সংকীর্ণ, অত্যন্ত কঠিন, অত্যন্ত ভণ্ড হইয়া রহিত। মৃত্যুর অভাবে কোনো বিষয়ে কোথাও দাঁড়ি দেবার জো থাকিত না।'
চরম খবরটা প্রত্যাশিত থাকলেও আমাদের মনে একটা ক্ষীণ আশা কাজ করছিল, নিউ ইয়র্কের ঝলমল রোদে হয়তো আবার নতুন করে জেগে উঠে ক্রিয়াশীল হবেন। হাতের কলম হয়ে উঠবে এবার তরবারি। প্রথমে খবরটা পাই আমাদের সদাজাগ্রত প্রজ্ঞাবান লেখক ফয়সল শাহরিয়ারের ফোনে। এমন সময় কবি নুরুন্নাহার শিরিন এসএমএস পাঠিয়ে হুমায়ূন আহমেদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন। আমি জোরালোভাবে বিশ্বাস করি না বলে অস্বীকার করলে শাহরিয়ার তখন নিউ ইয়র্ক থেকে তার কোনো এক বন্ধুর এসএমএসের দোহাই পাড়ে। ঠিক এমন সময় হুমায়ূনের একান্ত বন্ধু আসাদুজ্জামান নূর এমপির দেশ টিভির খবর শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সংবাদ পাঠিকা যখন আবার নতুন করে সংবাদের ইতি টানতে গিয়ে খবরটা পাকা করেন তখন গোটা বিশ্বসংসার আমার কাছে মুহূর্তের জন্য ব্ল্যাকআউট হয়ে যায়।
কত স্মৃতি, সেই অন্যদিনের মাযহারের অনুরোধে ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়ে আমাদের কলকাতার বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে। বিডিআরের দরবার হলে হুমায়ূন-কন্যার বিবাহবাসরের কলরব কোলাহল ছাড়িয়ে হুমায়ূনের নন্দনকানন নুহাশ পল্লীতে দু-তিন দিনের আতিথেয়তা কোনো দিন ভোলার নয়। এর পর থেকে হুমায়ূনের সঙ্গে বহুবার বহু জায়গায় দেখা হলে প্রীতি সম্ভাষণ বিনিময় ছাড়াও অনেক কথা হতো। প্রতিবারই ছিল নিত্যনতুন চমক। একবার এই নুহাশ পল্লীতে নৃত্যরতা শাওনের শুটিং দেখা, হুমায়ূনের উষ্ণ আপ্যায়ন, সন্ধ্যের সময় সজল ক্যাম্পফায়ার, পুকুর পাড়ে মাছ ধরা, সুইমিং পুলে সবাই মিলে অবগাহন- সবই ইতিহাস হয়ে আছে। আমার একটি অকিঞ্চিৎকর লেখায় 'দু গগনের তারা' লেখাতে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। বিদায় কথাটা আমি কখনো উচ্চারণ করি না। মুখে আসে না। আমি মনে করি, হুমায়ূন আছে, থাকবে। হুমায়ূন পরিবার তাঁর রাজ্যপাঠসহ আছে, থাকবে চিরদিন চিরকাল। অগণিত বন্ধুবান্ধব, ভক্ত, শত্রুমিত্র সবার হুল্লোড়ে চিরজীবী হয়ে থাকবে হুমায়ূন আহমেদ।

No comments

Powered by Blogger.