হুমায়ূন আহমেদ: বাংলা সাহিত্যের এক মহাজীবনের অবসান

উনিশশো আটচল্লিশ সালের তের নভেম্বর এক শীতের রাতে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের কুতুবপুর গ্রামে জন্ম কাজল-এর। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান কাজলের আনুষ্ঠানিক নাম হুমায়ূন আহমেদ।
চৌষট্টি বছরের জীবন শেষে থেকে দুই হাজার বারো সালের কুড়ি জুলাই আটলান্টিকের ওপারে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের এক হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্ত অবস্থায় যখন পাড়ি জমালেন হুমায়ুন, তখন নামেই তাকে চেনে সারা বিশ্বের বাংলাভাষী মানুষ।
জননন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ’র তো নয়, বৃহস্পতিবার রাতে সাড়ে এগারটায় অবসান ঘটলো বাংলা সাহিত্যের এক মহাজীবনের।

জীবিতকালেই হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয়তম লেখক। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং নাট্যকার। বলা হয়, বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও তিনি সমাদৃত। ২০১১ পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। অতুলনীয় জনপ্রিয়তা সত্বেও তিনি অন্তরাল জীবন-যাপন করতেন এবং লেখলেখি ও চিত্রনির্মাণের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।

বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসে তার নির্মিত দুই চরিত্র হিমু ও মিসির আলী নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয়তম।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন। এ বছরের শুরুতে জাতিসংঘে বাংলাদেশ দূতাবাসে সিনিয়র স্পেশাল অ্যাডভাইজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

পরিবার
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে জন্ম হুমায়ুন আহমেদের। তার বাবা ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন।  তার বাবা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুরে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন। হুমায়ুনের ছোট ভাই ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের জনপ্রিয়তম কল্পবিজ্ঞান লেখক। পরিবারের সবার ছোট ছেলে আহসান হাবীব রম্যসাহিত্যিক এবং কার্টুনিস্ট।

ছোটবেলায় হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল ছিল শামসুর রহমান; ডাকনাম কাজল। তার বাবা নিজের নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরে আবার নাম বদলে হুমায়ূন আহমেদ রাখেন।

হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর নাম গুলতেকিন আহমেদ। তাদের বিয়ে হয় ১৯৭৩ সালে। এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং দুই ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। অন্য আরেকটি ছেলে অকালে মারা যায়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে শীলার বান্ধবী এবং তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এর ফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসানকল্পে ২০০৫-এ গুলতেকিনের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয় এবং ওই বছরই শাওনকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।

শিক্ষা এবং কর্মজীবন
বাবার চাকুরি সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করার কারণে হুমায়ূন আহমেদকে দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করতে হয়েছে। তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সব গ্রুপে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন।

তার কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখি, নাটক নির্মাণ এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন।

সাহিত্যকর্ম
ছাত্রজীবনে ‘নন্দিত নরকে’ নামে উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যজীবনের শুরু। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-এ আহমদ ছফা’র উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স প্রকাশ করে। বাংলা ভাষাশাস্ত্রের প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ আহমদ শরীফ এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যামোদী মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ তার ২য় গ্রন্থ। তিনি দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস প্রকাশনা করেছেন। তিনি অনায়াসে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে অতিবাস্তব ঘটনাবলীর অবতারণা করেছেন তার রচনায়। তার গল্প ও উপন্যাস সংলাপপ্রধান ও বর্ণনা পরিমিত। সামান্য পরিসরে কয়েকটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে চরিত্র চিত্রণের অদৃষ্টপূর্ব প্রতিভা ছিল তার। তার রচনার আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল কোনো ধরনের ‘খলনায়কে’র অনুপস্থিতি। তার তৈরি চরিত্রগুলোর কেউই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত ভাবে খলনায়ক হিসেবে চিত্রায়িত নয়। সব চরিত্রের মধ্যেই মানুসের নানা মনোবৃত্তির নানামুখী রসায়ন ছাপ ফেলে যায়। অনেক রচনার মধ্যে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির ছাপ স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস মধ্যাহ্ন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। এছাড়া জোছনা ও জননীর গল্প আরেকটি রচনা যা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত। তবে সাধারণত তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে লিখেছেন।

ব্যক্তিজীবন
ঢাকা শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডির ৩/এ রোডে নির্মিত ‘দখিন হাওয়া’ এ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্লাটে স্থায়ী হয়েছিলেন তিনি। তবে ঢাকার অদূরে গাজীপুরের গ্রামাঞ্চলে স্থাপিত বাগান বাড়ী ‘নূহাশ পল্লী’তে প্রচুর সময় কাটাতেন। সাহিত্য পরিমণ্ডলের নানা দলাদলিতে তিনি কখনো নিজেকে জড়াননি। তিনি স্বল্পবাক, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অন্তরাল জীবন-যাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তিনি ছবি এঁকেও অবসর সময় কাটাতে ভালবাসেন। দেশে সাধারণ জনমানসে তার প্রভাব অনেক গভীর ও ব্যাপক। জাতীয় নানা বিষয়ে ও সঙ্কটে প্রায়ই তার বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করতো।

পুরস্কার
অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। যার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে; বাংলা একাডেমী পুরস্কার ১৯৮১, একুশে পদক ১৯৯৪, শিশু একাডেমী পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৩, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪) এবং লেখক শিবির পুরস্কার ১৯৭৩।

তার বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর কয়েকটি
নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, এইসব দিনরাত্রি, জোছনা ও জননীর গল্প, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথাও, সৌরভ, নি, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরীপুর জাংশান, বহুব্রীহি, আশাবরি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, নিশীথিনী, আমার আছে জল, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, আকাশ ভরা মেঘ, মহাপুরুষ, শূন্য, ওমেগা পয়েন্ট, ইমা, আমি এবং আমরা, কে কথা কয়, অপেক্ষা, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, পেন্সিলে আঁকা পরী, অয়োময়, কুটু মিয়া, দ্বিতীয় মানব, ইস্টিশন, মধ্যাহ্ন, মাতাল হাওয়া, শুভ্র গেছে বনে এবং ম্যজিক মুনসি।

‘হিমু’ চরিত্রকেন্দ্রীক উপন্যাস
ময়ুরাক্ষী, দরজার ওপাশে, হিমু, হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম, এবং হিমু, পারাপার, হিমুর রুপালী রাত্রি, একজন হিমু কয়েকটি ঝিঝি পোকা, হিমুর দ্বিতীয় প্রহর, তোমাদের এই নগরে, সে আসে ধীরে, আঙ্গুল কাটা জগলু, হিমু মামা, হলুদ হিমু কালো র‌্যাব, আজ হিমুর বিয়ে, হিমু রিমান্ডে, হিমুর মধ্যদুপুর, চলে যায় বসন্তের দিন, হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য, হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D.বল্টুভাই।

‘মিসির আলি’ চরিত্রকেন্দ্রীক উপন্যাস
দেবী, নিশিথিনী, বৃহন্নলা, আমিই মিসির আলি, কহেন কবি কালিদাস, ভয়, মিসির আলির অমিমাংসিত রহস্য, বাঘবন্দী মিসির আলি, মিসির আলির চশমা, মিসির আলি!আপনি কোথায়?, এবং যখন নামিবে আঁধার।

আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ
বলপয়েন্ট, কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেইন পেন, রংপেনসিল, নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ।

চলচ্চিত্র নির্মাণ
টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শক-নন্দিত নাটক রচনার পর হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তার পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। ২০০০ সালে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ও ‘দুই দুয়ারী’ চলচ্চিত্র দুটি দর্শকদের কাছে প্রচুর জনপ্রিয় হয়। ২০০৩-এ নির্মাণ করেন ‘চন্দ্রকথা’ নামে একটি চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করেন ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রটি। এটি ২০০৬ সালে ‘সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে একাডেমি পুরস্কার এর জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। তার সব চলচ্চিত্রে তিনি নিজে গান রচনা করেন। সর্বশেষ ২০০৮-এ ‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন তিনি।
এছাড়াও তার লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ২০০৬ সালে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘দুরত্ব’, বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নন্দিত নরকে’ এবং আবু সাইদ পরিচালিত ‘নিরন্তর’। ২০০৭-এ শাহ আলম কিরণ পরিচালিত ‘সাজঘর’ এবং তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন ‘দারুচিনি দ্বীপ’।

নাটক
টিভি নাটক: ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য নাটক রচনা শুরু করেন তিনি। এটি তাকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশীর মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে।

তার অন্যতম ধারাবাহিক নাটক এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময় এবং আজ রবিবার। এগুলোর বেশিরভাগই ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এর দশকে নির্মিত। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি অনেক প্যাকেজ নাটক নির্মাণ করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.