চাঁদহীন রাতে কেন চলে যাবেন, হুমায়ূন আহমেদ by আনিসুল হক

এমন তো কথা ছিল না, প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ স্যার। আপনার না জোছনা রাতে মারা যাওয়ার কথা। চাঁদনি পসর রাতে। ‘জোছনা আমার অতি প্রিয় বিষয়। প্রতি পূর্ণিমাতেই নুহাশপল্লীতে যাই জোছনা দেখতে, সঙ্গে পুত্র নিষাদ, নিনিত এবং তাদের মমতাময়ী মা। প্রবল জোছনা আমার মধ্যে একধরনের হাহাকার তৈরি করে।
সেই হাহাকারের সন্ধান করে জীবন পার করে দিলাম।’ হুমায়ূন আহমেদ ২০১২ সালে প্রকাশিত বইয়ের মলাটে নিজেই লিখেছেন। আরেকটা বইয়ের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, ‘চাঁদনি পসর রাতে যেন আমার মরণ হয়’, এই গানটির কথা। লিখেছিলেন, শাওনের কণ্ঠে এই গানটা তাঁর খুব প্রিয়। আর, তিনি প্রবল জোছনার তোড়ে ভেসে যাওয়া কোনো রাতে মারা যেতে চান।
বাংলাদেশে বৃহস্পতিবার অমাবস্যা। শুক্রবার চাঁদ উঠবে, শনিবার রোজা। পূর্ণিমা আসতে ঢের দেরি। হুমায়ূন আহমেদ স্যার কি তা জানেন? কেন তিনি অমাবস্যার রাতে আমাদের অন্ধকারে, দুঃখ আর শোকের কালো সাগরে ডুবিয়ে মারা যাবেন?
‘নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ’, প্রথম আলোয় কলাম লিখেছেন কিছুদিন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে যাওয়ার পরের দিনগুলোয়। আমেরিকায় গিয়ে রাতের আকাশে চাঁদ দেখলে মনে হয়, এই দেশের সবকিছুই বিদেশি, কেবল চাঁদটা আমার বাংলাদেশের। হুমায়ূন আহমেদ স্যার কি জোছনা আসার জন্যও অপেক্ষা করতে পারলেন না?
একটু আগে ফরিদুর রেজা সাগর ফোন করেছিলেন (বৃহস্পতিবার রাতে)। এত রাতে তাঁর ফোন পেয়েই আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। গত বছর ফরিদুর রেজা সাগর ভাই-ই আমাকে জানিয়েছিলেন, হুমায়ূন আহমেদ স্যারের ক্যানসার। ফোনের বাটন টিপে আমি বলি, হ্যালো। গলা কাঁপছে আমার। সাগর ভাই বলেন, ‘মাজহারের সঙ্গে কথা হলো, হুমায়ূন ভাইয়ের খবর ভালো না। তোমরা একটু খোঁজ নাও।’
হুমায়ূন আহমেদ স্যারের স্বাস্থ্যটা ভালো নয়। তিনি প্রায় অচেতন অবস্থায় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আছেন, ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, তাঁকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছে, এটা গত বুধবারের খবর। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম ও মেহের আফরোজ শাওন এক বিবৃতিতে বুধবারে এটা আমাদের জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ৫০। প্রথম আলোর সাহিত্য পাতার সম্পাদক লেখক আলীম আজিজ একটু আগে মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানালেন, হুমায়ূন স্যারের রক্তচাপ দ্রুত কমে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ৪০ বাংলাদেশ সময়। আলীম আজিজই খবর দিলেন, স্যার আর নেই।
হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম গত মে মাসে। ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’ নামের বাড়িটার ফ্ল্যাটে। স্যার নিউইয়র্ক থেকে কেমো নিয়ে ফিরেছেন। মা এবং মাটির টানে এসেছেন। আবার চলে যাবেন। কারণ, সামনে তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার করা হবে।
আমি নীরবে গিয়ে তাঁর লেখার ঘরে ঢুকে পড়ি। তিনি একা একা কথা বলছেন আর লিখছেন। আমি তাঁর কাজে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। স্যার একটা নাটক লিখছেন। সেই নাটকের সংলাপ একবার এ চরিত্রের হয়ে, আরেকবার ও চরিত্রের হয়ে লিখছেন। স্যার লিখতে লিখতে মুখ তুলে চেয়ে বলেন, ‘এসেছ, বসো।’ আমি বলি, না, আপনাকে বিরক্ত করি না। আপনি লেখেন। ভালো থাকেন। সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন।
‘আচ্ছা, আমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পরে এসো। অনেক গল্প করব।’
স্যার, সেই গল্পগুলো কি হবে না? আপনি আসবেন না আর ‘দখিন হাওয়া’য়?
পরে হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আবার দেখা বসুন্ধরা মার্কেটের সিঁড়িতে। স্যার, শাওন, স্যারের মা আয়েশা ফয়েজ—সবাই মাইক্রোবাস থেকে নামছেন। আমিও নামছি আমার গাড়ি থেকে। মঙ্গলবার। ফাঁকা মার্কেট। আমি গিয়ে স্যারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একসঙ্গে এক লিফটে উঠলাম। আমরা চলেছি হুমায়ূন স্যারের নতুন ছবি ঘেটুপুত্র কমলার উদ্বোধনী প্রদর্শনী দেখতে। স্যার একদম সুস্থ মানুষের মতো চলাফেরা করছেন। পুরো ছবি দেখলেন। ছবি দেখার আগে কথা বললেন। সবার সঙ্গে শিল্পী-কলাকুশলীদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্বভাবসুলভ রসিকতা করলেন, ‘ছবি আমরা বানাবই। বানিয়েই যাব।’
স্যার, আপনার না আরও আরও ছবি বানানোর কথা?
এই লেখার শুরুতে যে বইয়ের মলাট থেকে হুমায়ূন স্যারের কথা উদ্ধৃত করেছি, সেখানেই তিনি লিখেছেন, ‘১৩ নভেম্বর মধ্যরাতে আমার জন্ম। সন ১৯৪৮। হ্যাঁ, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। লেখালেখি করছি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। আমি আনন্দিত, ক্লান্তি এখনও স্পর্শ করেনি।’
বাংলাসাহিত্যের কিংবদন্তি তিনি। সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় লিখেছেন মৌলিক সব আশ্চর্য উপন্যাস, ছোটগল্প। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার থেকে শুরু করে মধ্যাহ্ন—কী আশ্চর্য সব সৃষ্টি। বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক। তাঁর অয়োময় কিংবা বহুব্রীহি কিংবা কোথাও কেউ নেই-এর কথা কে ভুলতে পারবে? আগুনের পরশমণি কিংবা শ্রাবণ মেঘের দিন-এর মতো সিনেমা আমাদের আবার সিনেমা হলে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে, আমাদের চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে। আজকের ছেলেমেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজতে চায়, জোছনা দেখতে চায়, সে তো তাঁর কাছ থেকে শেখা। তারা ‘হিমু’ হতে চায়, ‘মিসির আলী’র মতো করে যুক্তি খোঁজে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের গদ্য আজ সহজ, কিন্তু সুন্দর—সে তো হুমায়ূন পড়ে পড়েই শেখা। আমাদের প্রকাশনাশিল্পকে প্রায় একাই তিনি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, ধরে রেখেছেন। এই কথাগুলো এখন অতীত কাল দিয়ে লিখতে হবে? বলতে হবে, তিনি ছিলেন। তিনি করেছিলেন। তিনি আর নেই? সামনের বইমেলায় তিনি আসবেন না? আমাদের ঈদসংখ্যাগুলোর কী হবে? কী হবে ঈদের সন্ধ্যায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর? আমাদের প্রকাশনাজগৎ এই শূন্যতা সইতে পারবে?
বাংলাদেশে পূর্ণিমা আসতে ঢের দেরি। আর, তাঁরও নতুন নতুন ছবি বানানোর কথা, দেয়াল উপন্যাসটা আমাদের হাতে তুলে নিয়ে নতুন উপন্যাস নিয়ে কাজ করার কথা। লেখকদের গল্প শেষ না করে মাঝপথে চলে যেতে নেই। ৬৪ বছর প্রস্থানের জন্য মোটেও উপযুক্ত বয়স নয়।
কিন্তু কোটি কোটি পাঠককে, ভক্তকে শোকের অমাবস্যায় ঢেকে দিয়ে তিনি চলে গেলেন।
তবে এই যাওয়া মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়। তাঁর অবিনশ্বর কীর্তি, তাঁর সাহিত্য, তাঁর ছবি, তাঁর শিল্পকর্ম তাঁকে আমাদের মাঝে ধরে রাখবে বহুকাল।
হুমায়ূন আহমেদের মতো প্রাণপ্রাচুর্যভরা মানুষের, সৃষ্টিশীল প্রতিভার মৃত্যু নেই।
এই দেশে আবারও আকাশ ভেঙে জোছনা আসবে। উথালপাতাল বৃষ্টি নামবে নীপবনে। সেই সব জোছনায়, সেই কদম ফুলের রেণুতে আমরা হুমায়ূন আহমেদকে পাব। তিনি আমাদের চৈতন্য এবং নিসর্গের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে থাকবেন।
আমরা যারা তাঁর সমসাময়িক কালে বাংলাদেশে ছিলাম, তারা কোনো দিনও তাঁকে ভুলতে পারব না। হয়তো তাঁকে মনে রাখবে বাংলার ভবিষ্যৎ কালও, মনে রাখবে তাঁর পাঠকেরা; আর এই বাংলার জোছনা, বৃষ্টি, কদম ফুল।

No comments

Powered by Blogger.