উদ্ভাবনী আসরে by পল্লব মোহাইমেন

নামের মতোই সুন্দর সিডনির ডারলিং হারবার। শীতের সিডনির মৃদুমন্দ ঢেউয়ে পোতাশ্রয়ের নীল পানিতে সাঁতার কাটে নানা আকার-আকৃতির নৌযান। আশপাশে গাংচিলের ওড়াউড়ি। হারবারের একদিকে সিডনি অ্যাকুয়ারিয়াম, মাদাম তুসোর জাদুঘর, অপরদিকে মেরিটাইম মিউজিয়াম।
লাল ইটে বাঁধানো চাতাল পেরিয়ে এক পাড়ে সিডনি সম্মেলন ও প্রদর্শনী কেন্দ্র।
গত ৬ জুলাই সকালে হারবারের ওপরে পায়ে হাঁটার সেতু পেরোনোর সময়ই টের পাওয়া গেল উৎসবমুখর পরিবেশ। দীর্ঘ সেতুর দুই পাশে অসংখ্য পতাকা পত পত করে উড়ছে। সবই ইমাজিন কাপের পতাকা। ইমাজিন কাপ তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাইক্রোসফট করপোরেশনের বিশাল এক আয়োজন। উদ্ভাবনী শক্তি, সৃজনশীল ভাবনার সঙ্গে প্রযুক্তি-যোগ দুর্দান্ত সব সফটওয়্যার, গেমস, প্রযুক্তিগত সমাধান তৈরির প্রতিযোগিতা হলো ইমাজিন কাপ।
পৃথিবীর ৭৫টি দেশ থেকে প্রতিযোগী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আগের রাতেই চলে এসেছেন সিডনি। ৬ জুলাই সকাল থেকেই তাঁদের দীপ্ত তারুণ্যে উচ্ছল যেন গোটা ডারলিং হারবার। আর এ আয়োজনের মূল স্থান সিডনি সম্মেলন ও প্রদর্শনী কেন্দ্র তাঁদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত। এই দিন বিকেলেই আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো ইমাজিন কাপের।
প্রোগ্রামারদের নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের দেখভাল করেন, তাঁদের গড়ে তোলেন; মাইক্রোসফটের সেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেই দিলেন—এ আয়োজন তারুণ্যের। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়, তরুণ প্রযুক্তিবিদেরা যাতে আগামী দিনে সফল উদ্যোক্তা হতে পারেন, সে জন্য যাবতীয় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত প্রতিষ্ঠানটি। আর সে জন্যই এ আয়োজন। এ ছাড়া প্রতিযোগিতায় যেসব সফটওয়্যার তৈরি করে আনেন প্রতিযোগীরা, সেসব দিয়ে যেন পৃথিবীর নানা ধরনের সমস্যার সমাধান করা যায়। এবারের ইমাজিন কাপের মূল বিষয়ই ছিল ‘এমন একটা বিশ্বের কথা ভাবুন, যেখানে প্রযুক্তি কঠিনতর সমস্যা সমাধানে সহায়তা করছে...।’
তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে মোড়া জমকালো উদ্বোধনের পর ৭ জুলাই থেকে শুরু হয় আসল প্রতিযোগিতা। প্রতিদিন বিচারকদের সামনে দলগুলোর তৈরি প্রকল্পের উপস্থাপন, প্রকল্পের প্রদর্শনী, ছাত্র-ছাত্রীদের আনন্দ আয়োজন—এভাবে কেটে গেছে পাঁচটি দিন। ১০ জুলাই ফলাফল জানিয়ে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। তারুণ্যের মেধার স্বীকৃতি মেলে। এর পরও যেন শেষ হয় না। বিভিন্ন দেশের বাছাই পর্বের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে যেসব দল চূড়ান্ত পর্বে অংশ নিয়েছে, সেসব দল তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে মাইক্রোসফটের কাছে অনুদান চেয়ে আবেদন করতে পারবে। মাইক্রোসফট বিচার-বিবেচনা করে কিছু প্রকল্পে অনুদান দেবে।
২০০৩ সালে স্পেনের বার্সেলোনা থেকে শুরু হয়েছিল ইমাজিন কাপের যাত্রা। সেবার এতে অংশ নিয়েছিল ২৫টি দেশ। এ বছর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে হলো প্রতিযোগিতার দশম আসর। ৭৫টি দেশের ১০৬টি দল এসেছিল প্রতিযোগিতায়। এর মধ্যে সফটওয়্যার ডিজাইন প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি ৭২টি দলের অংশগ্রহণ দেখা গেছে। এবার মোট ২৭টি পুরস্কারে এক লাখ ৭৫ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছে বিজয়ীদের। প্রতিযোগিতার ৪০ শতাংশ প্রকল্প ছিল স্বাস্থ্যসেবাভিত্তিক। ২০ শতাংশ নারী প্রতিযোগী অংশ নিয়েছেন এবার। কাইনেট ব্যবহার করে এক্সবক্সের জন্য ৬৬ শতাংশ প্রকল্প দেখা গেছে এবার, উইন্ডোজ ৮ ব্যবহার করা হয়েছে ২০ শতাংশ প্রকল্পে।

কাপ ইউক্রেনের
ইমাজিন কাপে আটটি শাখায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিসেবে পুরস্কার ছিল ২৪টি। এ ছাড়া ছিল তিনটি পুরস্কার। সবচেয়ে বড় পুরস্কার অর্থাৎ কাপ হলো সফটওয়্যার ডিজাইন শাখায়। এ শাখায় প্রথম পুরস্কার ২৫ হাজার ডলার। বাকি সব শাখায় প্রথম পুরস্কার আট হাজার ডলার করে। শুধু পিপলস চয়েস পুরস্কারের মান ১০ হাজার ডলার।
ইমাজিন কাপের প্রদর্শনী অংশে দেখা যাচ্ছিল একজন প্রতিযোগী সেন্সর লাগানো গ্লাভস পরে নানা রকম ইশারা করছেন। সেই ইশারা কম্পিউটারে বাঙ্ময় হয়ে উঠছে। আবার দলের আরেকজন হয়তো কথা বলছেন, সেটা ইশারা ভাষায় রূপান্তর হয়ে যাচ্ছে। এনাবল টক নামের এই প্রকল্পটি ইউক্রেনের কোয়াডস্কোয়াড দলের। এই দলটি ২০১২ সালের ইমাজিন কাপ প্রতিযোগিতায় শীর্ষ পুরস্কারটি অর্জন করে। সফটওয়্যার ডিজাইনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে জাপান ও পর্তুগাল। আরও যে তিনটি দল চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিল সেগুলো হলো গ্রিস, নিউজিল্যান্ড ও থাইল্যান্ড।
উইন্ডোজ ফোনের জন্য গেম ডিজাইনে প্রথম স্থান অর্জন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রেক্সেল ড্রাগনস দল। গণিত চর্চার গেম বানিয়ে দলটি জেতে প্রথম পুরস্কার। পরের দুটি স্থানে আছে ফ্রান্স ও হাঙ্গেরি। এক্সবক্স ও উইন্ডোজের জন্য গেম ডিজাইন শাখায় শীর্ষে আছে থাইল্যান্ডের ট্যাং থাই দলটি। তাদের তৈরি গেম ভারডেন্ট ফ্যানটাসি গাছ কাটা প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। একদল দৈত্য গাছ কেটে বন উজাড় করছে। তাদের তাড়িয়ে বৃক্ষের সংখ্যা বাড়ানোই হবে গেম খেলোয়াড়ের কাজ। এ শাখায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে ব্রাজিল ও বেলজিয়াম।
ইমাজিন কাপে অন্য শাখাগুলোতে প্রথম পুরস্কার বিজয়ী দেশগুলো হলো—ব্রাজিল (কাইনেক্ট ফান ল্যাবস চ্যালেঞ্জ, উইন্ডোজ মেট্রো স্টাইল অ্যাপ ও উইন্ডোজ আজুরে চ্যালেঞ্জ), রোমানিয়া (আইটি চ্যালেঞ্জ) ও মিসর (উইন্ডোজ ফোন চ্যালেঞ্জ)।
কোকাকোলার সৌজন্যে অনলাইন ভোটে পিপলস চয়েস পুরস্কার পেয়েছে ভারত, পরিবেশবিষয়ক পুরস্কার জিতেছে জার্মানি আর স্বাস্থ্যসচেতনতাবিষয়ক পুরস্কার পেয়েছে ইতালি।

বাংলাদেশের অন্নপূর্ণা
ইমাজিন কাপের চূড়ান্ত পর্বে এই নিয়ে দুবার অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর বাছাই পর্বে বিজয়ী হয়ে চূড়ান্ত পর্বে যায় বাংলাদেশের ইঞ্জিন দলের সফটওয়্যার অন্নপূর্ণা। ওয়েব এবং উইন্ডোজ ফোনভিত্তিক অন্নপূর্ণা ভৌগোলিক অবস্থানে মাটির অবস্থা বুঝে সঠিক বীজ নির্বাচন ও সারের সঠিক ব্যবহার বলে দেয়। বাংলাদেশের তিন হাজার গ্রামের মাটির তথ্য নিয়ে এর একটা ডেটাবেইসও আছে। প্রতিযোগিতায় সেরা ২০-এর তালিকায় স্থান হয়নি এই সফটওয়্যারের। তবে পিপলস চয়েস পুরস্কারে তৃতীয় স্থানে আছে অন্নপূর্ণা। সিডনিতে দলনেতা খালিদ মাহমুদ বললেন, ‘অন্নপূর্ণাকে বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে চাই। এটি খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। পাশাপাশি সার ও কীটনাশকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করে রোগব্যাধিও কমিয়ে আনতে পারবে।’

তরুণদের আছে উদ্ভাবনী শক্তি
প্রোগ্রামারদের কাজ করার জন্য নানা রকম বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট এখন সহজলভ্য। ফলে প্রযুক্তিজ্ঞান আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকলে যে কেউই দারুণ সব সফটওয়্যার বানাতে পারে। আর নিজেকে তুলে ধরতে পারে বিশ্বের সামনে। সিডনিতে আলাপচারিতায় এমনটাই বললেন মাইক্রোসফটের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একাডেমিক লিড ভিনসেন্ট কুয়াহ্। আরও যোগ করলেন, বাংলাদেশের প্রোগ্রামাররা নিজেদের কাজে বেশ ভালো। ভবিষ্যতে তারা ভালো করবে বলে তিনি আশাবাদী।
অক্টোবরের শেষ নাগাদ আসছে উইন্ডোজ ৮ অপারেটিং সিস্টেম। মাইক্রোসফটের আশা, নতুন এই অপারেটিং সিস্টেম প্রযুক্তি দুনিয়ায় বড় ধরনের বদল আনবে। মাইক্রোসফট চালু করছে ইকো সিস্টেম। যেটি হবে সবার জন্য উন্মুক্ত একটি জায়গা। অনলাইনে একটি ক্লিক করে যে কেউ তার প্রযুক্তিগত ধারণা জমা দিতে পারবে। নিজের চিন্তাভাবনা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করা যাবে এই ইকো সিস্টেমে। মানেটা হলো,
তরুণ উদ্ভাবকদের জন্য এখন সম্ভাবনার দুয়ারটা খোলা।

No comments

Powered by Blogger.