অন্য ভুবনে হুমায়ূন আহমেদ

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ, কিংবদন্তিসম ব্যক্তিত্ব, জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ আর নেই (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২০ মিনিটে তিনি অন্তিম শ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।


রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে এক শোকবার্তায় বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের বহুমাত্রিক সৃজনশীল রচনা কালজয়ী হয়ে থাকবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রতিক্রিয়ায় শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদের অনন্য অবদানের জন্য জাতি তাঁকে কখনো ভুলবে না।’
জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া তাঁর শোকবাণীতে বলেন, ‘তাঁর মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
তাঁরা সবাই মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
বৃহদন্ত্রের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। বেলভিউ হাসপাতালে দুবার অস্ত্রোপচারের পর তাঁর অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছিল না। সপ্তাহ খানেক থেকে অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে। তিন দিন থেকে তাঁকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছিল। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন তিনি। চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা এবং সারা বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী অগণিত ভক্তের মঙ্গল কামনা সত্ত্বেও তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।
নিউইয়র্ক থেকে সাংবাদিক আশরাফুল আলম গত রাতে জানান, বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন। বিমানের ফ্লাইট পাওয়া সাপেক্ষে যত দ্রুত সম্ভব তাঁর মরদেহ দেশে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এর আগে স্থানীয় বাঙালিদের উদ্যোগে নিউইয়র্কে প্রথম জানাজা সম্পন্ন হবে।
বৃহদন্ত্রে ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর তিনি চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে যান। সেখানে স্লোয়ান-ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন। দুই দফায় মোট ১২টি কেমো দেওয়ার পর গত মাসে বেলভিউ হাসপাতালে অনকোলজি বিভাগের প্রধান জেইন এবং ক্যানসার সার্জন জজ মিলারের নেতৃত্বে তাঁর দেহে দুই দফা অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল।
সংক্ষিপ্ত জন্মবৃত্তান্ত
হুমায়ূন আহমেদের জন্ম নেত্রকোনার কুতুবপুরে ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। মায়ের নাম আয়েশা ফয়েজ। তাঁরা তিন ভাই ও দুই বোন। অন্য দুই ভাই হলেন লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবিব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র হুমায়ূন আহমেদ পাঠ শেষে ওই বিভাগেই প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
বাংলাদেশের লেখালেখির ভুবনে প্রবাদপুরুষ হুমায়ূন আহমেদ সত্তর দশকের শুরুতে ছাত্র অবস্থাতেই লেখালেখি শুরু করেন। তবে ১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে প্রকাশিত হওয়ার পরেই পাঠকের মন জয় করে নেন। অর্জন করেন বিপুল জনপ্রিয়তা। তিনি মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা সহজ-সরল গদ্যে তুলে ধরে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। শুধু মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা বয়ানেই সীমিত নয় তাঁর কৃতিত্ব, বেশ কিছু সার্থক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির লেখকও তিনি। জনপ্রিয় চরিত্র ‘মিসির আলী’ ও ‘হিমু’র স্রষ্টা তিনি—যে দুটি চরিত্র যথাক্রমে ‘লজিক’ এবং ‘অ্যান্টিলজিক’ নিয়ে কাজ করে। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা দুই শতাধিক। ঔপন্যাসিক হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর মতো এত জনপ্রিয়তা আর কেউ পাননি।
একটা পর্যায়ে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখি, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণে নিমগ্ন হন। উপন্যাস রচনার পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকেও তিনি একটি নিজস্ব ঘরানা সৃষ্টি করেন। বদলে দেন টিভি নাটকে গতানুগতিক ধারা। বিটিভিতে সম্প্রচারিত প্রথম ধারাবাহিক টিভি নাটক এইসব দিনরাত্রি মধ্য আশির দশকে তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁর হাসির নাটক বহুব্রীহি এবং ঐতিহাসিক নাটক অয়োময় বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে একটি অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক কোথাও কেউ নেই-এর ‘বাকের ভাই’ নামের একটি চরিত্র যেন বাস্তব হয়ে উঠেছিল টিভি দর্শকের কাছে। নাটকের শেষে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির রায় হলে ঢাকার রাজপথে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবিতে মিছিল হয়েছিল। এমন ঘটনা এর আগে আর ঘটতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া অসংখ্য বিটিভি নাটক ও প্যাকেজ নাটকের নির্মাতা তিনি।
নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণেও তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা প্রভৃতি চলচ্চিত্র কেবল সুধীজনের প্রশংসাই পায়নি, মধ্যবিত্ত দর্শককেও হলমুখী করেছে বহু দিন পর।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে গুলতেকিনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হুমায়ূন ও গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলেমেয়ে। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর তিনি অভিনেত্রী ও পরিচালক মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। হুমায়ূন-শাওন দম্পতির দুই ছেলে।
হুমায়ূন আহমেদ একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.