চলে গেলেন সাহিত্যের রাজপুত্র by আজিজুল পারভেজ ও নওশাদ জামিল

বাংলা সাহিত্যের মহাকাশ থেকে খসে পড়ল হুমায়ূন আহমেদ নামের অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রটি। দীর্ঘ ১০ মাস ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই শেষে চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের নন্দিত এই রাজপুত্র। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলদেশ সময় রাত ১১টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।


জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এম এ মোমেন গতকাল রাতে ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। নিউ ইয়র্ক থেকে তাঁর মরদেহ দেশে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এই লেখকের বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। গতকাল রাতে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশ শোকের চাদরে ঢেকে যায়। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ সর্বস্তরের মানুষ। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষীরাও এই শোকের মিছিলে শামিল হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হুমায়ূন আহমেদ মারা যান। তাঁর দেহে একটি ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছিল, যা শনাক্ত করা যাচ্ছিল না বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন। বৃহদান্ত্রে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর গত ১৪ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য নিউ ইয়র্কে যান হুমায়ূন আহমেদ। সেখানে মেমোরিয়াল স্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন তিনি।
উপন্যাস, ছোটগল্প, সায়েন্স ফিকশন, টিভি নাটক, চলচ্চিত্রের মতো বহু ক্ষেত্রে বিস্তৃত জাদুকরী লেখক হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কুতুবপুর গ্রামে। ডাকনাম ছিল কাজল। ছিলেন পাঁচ ভাই ও বোনের মধ্যে সবার বড়। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুরে এসডিপিও হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তিনি শহীদ হন। এরপর মা আয়েশা ফয়েজ তিন ছেলে ও দুই মেয়ের সংসারের হাল ধরেন। নানা সংগ্রাম মোকাবিলা করেই দাঁড়াতে হয়েছে এই পরিবারকে। হুমায়ূন আহমেদের অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল খ্যাতিমান কম্পিউটার বিজ্ঞানী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব স্বনামধন্য রম্য লেখক ও কার্টুনিস্ট।
লেখকজীবনের শুরুতেই হুমায়ূন আহমেদ তাঁর চারপাশে বিস্ময়ের রেণু ছড়িয়ে দেন 'নন্দিত নরকে' নামে প্রথম উপন্যাসের মাধ্যমে। সবাই তখনই বুঝে নেন বাংলা সাহিত্যের জগতে অনন্যসাধারণ এক লেখকের আবির্ভাব ঘটে গেছে। পরের সময় শুধুই সামনে এগিয়ে চলার, সাফল্যের মণি-মুক্তা কুড়িয়ে নেওয়ার। হুমায়ূন আহমেদ যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। তাঁর উপন্যাসের হিমু, মিসির আলী কিংবা নাটকে বাকের ভাইয়ের মতো চরিত্ররা আজ চিরায়ত।
১৯৮১ সালে ভূষিত হন বাংলা একাডেমী পুরস্কারে। একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি লেখালেখি, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। বন্ধুবৎসল ও প্রকৃতিপ্রেমী এই লেখক ঢাকার অদূরে গাজীপুরে গড়ে তোলেন নুহাশ পল্লী নামে এক স্বপ্নের আবাসভূমি। ক্যান্সার চিকিৎসার মধ্যে ২০ দিনের বিরতি পেয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে যখন ফিরে আসেন দেশের মাটিতে, সে সময়টা তিনি কাটান নুহাশ পল্লীতেই। আবার নিউ ইয়র্কে ফিরে যান গত ১ জুন।
প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের বিয়ে হয় ১৯৭৩ সালে। এই দম্পতির তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা, নোভা ও শীলা। ছেলের নাম নুহাশ। অন্য ছেলে অকালে মারা যায়। ২০০৫ সালে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ওই বছর তিনি বিয়ে করেন অভিনেত্রী ও পরিচালক মেহের আফরোজ শাওনকে। এ ঘরে জন্ম নেয় তিন ছেলেমেয়ে। প্রথম সন্তান কন্যা, মারা যায় ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়। ছেলেদের নাম নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন।
হুমায়ূন আহমেদের শৈশবের প্রথম অধ্যায়টি যতটা স্নেহ ও মমতায় কেটেছে, দ্বিতীয় অধ্যায়টি কেটেছে ততটা বঞ্চনার ভেতর দিয়ে। শৈশবে তাঁর মা টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হন। সুস্থ হওয়ার পর তাঁর স্মৃতিভ্রম দেখা দেয়। তিনি কাউকেই চিনতে পারছেন না, এমনকি তাঁর ছেলেকেও না। ফলে হুমায়ূন আহমেদকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নানার বাড়ি মোহনগঞ্জে। সেখানে দুই বছর তিনি নানা-নানির আদরে বেড়ে ওঠেন।
দুই বছর পর মা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপর হুমায়ূন আহমেদের ১০ বছর বয়স পর্যন্ত কেটেছে হেসে-খেলে। বাবার চাকরি সূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে তিনি শৈশব কাটিয়েছেন।
সিলেট থেকে বাবা বদলি হন দিনাজপুরের জগদ্দলে। সেখানে জঙ্গলের ভেতর এক জমিদারবাড়িতে তাঁরা থাকতেন। জগদ্দলের দিনগুলো তাঁর কাছে ছিল একেবারে অন্য রকম। বাবার সঙ্গে জঙ্গলে ভ্রমণ করতেন। গুলিভর্তি রাইফেল হাতে বাবা তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতেন। জঙ্গল পেরোলেই নদী। দুপুরে সেই নদীতে গোসল করতেন। একবারেই আলাদা এক জীবন।
জগদ্দল থেকে আবার বদলি পঞ্চগড়ে। সেখানে ভোরবেলা বাসার সামনে দাঁড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার-শুভ্র চূড়া চোখের সামনে ঝলমল করে উঠত। পঞ্চগড় থেকে এবার রাঙামাটি। পাহাড়ি উপত্যকায় আবার সেই উদ্দাম ঘুরে বেড়ানোর দিন। হুমায়ূন আহমেদের শৈশব কেটেছে এমনই স্বপ্নময়তায়।
প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদ দুষ্টুমি করে কাটালেও পরে বদলে যান। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে স্কুলের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়তে থাকে। আগ্রহটা এমনই ছিল যে এসএসসি পরীক্ষায় তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। এই পরীক্ষায়ও তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে তিনি একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অধ্যাপক জোসেফ এডওয়ার্ড গ্লাসের তত্ত্বাবধানে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন হুমায়ূন আহমেদ। লেখালেখি ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত সময় দেওয়ার জন্য একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পেশা ছেড়ে দেন।
১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় 'নন্দিত নরকে' উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর আত্মপ্রকাশ। এই উপন্যাস প্রকাশের পর তাঁর অমিত সম্ভাবনা টের পেয়ে প্রখ্যাত লেখক-সমালোচক আহমদ শরীফ একটি লেখার মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদকে অভিনন্দিত করেছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের ভিত গড়ে ওঠে পারিবারিক বলয় থেকেই। তাঁর বাবা ছিলেন সাহিত্যের অনুরাগী। বাসায় নিয়মিত সাহিত্য আসর বসাতেন। সেই আসরের নাম ছিল সাহিত্য বাসর। গল্প লেখার অভ্যাসও ছিল তাঁর; যদিও সেসব গল্প কোথাও ছাপা হয়নি। তবে গ্রন্থাকারে তা প্রকাশিত হয়েছিল। সন্তানদের মধ্যে যাতে সাহিত্যবোধ জেগে ওঠে, সে চেষ্টা করেছেন তাঁর বাবা। মাঝেমধ্যে তিনি নির্দিষ্ট একটা বিষয় দিয়ে ছেলেমেয়েদের কবিতা লিখতে বলতেন। ঘোষণা করতেন, যার কবিতা সবচেয়ে ভালো হবে, তাকে দেওয়া হবে পুরস্কার।
হুমায়ূন আহমেদের বড় মামা শেখ ফজলুল করিম, যিনি তাঁদের সঙ্গেই থাকতেন এবং ছিলেন তাঁদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তিনি কবিতা লিখতেন, লিখতেন নাটক এবং সেই নাটক তিনি তাঁর ভাগনে-ভাগিনীদের দিয়ে বাসায় গোপনে মঞ্চায়নও করাতেন। আর হুমায়ূন আহমেদের নিজের ছিল গল্প, উপন্যাসের প্রতি অসাধারণ টান।
নন্দিত নরকের পর একে একে শঙ্খনীল কারাগার, গৌরীপুর জংশন, অয়োময়, দূরে কোথাও, ফেরা, অমানুষ, জোছনা ও জননীর গল্প, কোথাও কেউ নেই, শ্যামল ছায়া, আমার আছে জল, অচিনপুর, ময়ূরাক্ষী, হিমু, আমিই মিসির আলীসহ দুই শতাধিক উপন্যাসের স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে তাঁর বিশেষ আলোচিত উপন্যাস 'দেয়াল'।
চলচ্চিত্র নির্মাণেও তিনি ছিলেন এক সুদক্ষ কারিগর। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র 'আগুনের পরশমণি'। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্র শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র 'শ্যামল ছায়া' বিদেশি ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তাঁর অন্য কীর্তি 'শ্রাবণ মেঘের দিন', 'দুই দুয়ারি', 'চন্দ্রকথা' প্রভৃতি চলচ্চিত্র। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে সর্বশেষ চলচ্চিত্র 'ঘেটুপুত্র কমলা'।
টিভি নাট্যকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের ছিল ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। আশির দশকের মাঝামাঝি তাঁর প্রথম টিভি নাটক 'এইসব দিনরাত্রি' তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁর লেখা 'বহুব্রীহি' ও 'অয়োময়' বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। 'কোথাও কেউ নেই'-এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। শিল্পের আরেকটি শাখা চিত্রকলাতেও তিনি তাঁর হাতের স্পর্শ রেখেছেন। তাঁর চিত্রকর্ম টাঙানো রয়েছে নিজ বাড়ির দেয়ালে। পাশাপাশি অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতাও তিনি।
শোক : নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
গত রাতে তাৎক্ষণিক এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্য হুমায়ূন আহমেদের অভাব বোধ করবে।'
বিরোধীদলীয় নেতা শোকবার্তায় বলেন, জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে এক বড় শূন্যতার সৃষ্টি হলো। এই ক্ষতি সহসা পূরণ হওয়ার নয়। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশের বরেণ্য ও নন্দিত এই লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, 'হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।' শোকবার্তায় তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।
জনপ্রিয় এই লেখকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। এক বার্তায় তাঁরা বলেন, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। সাহিত্যের অগ্রগতিতে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, জাতি চিরদিন তা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
তাঁর জীবন

No comments

Powered by Blogger.