শিক্ষাঙ্গনে যৌন নিপীড়ন-নারীর ক্ষমতায়নে বড় বাধা by সালমা খান

সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশে আশির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এই বিশ্ববিদ্যালয় ‘সৌরভে-গৌরবে’ শতবর্ষ পূর্তির পথে এগিয়ে চলেছে। শুধু কালের নিরিখে নয়, বাংলাদেশের সৃষ্টি ও রূপান্তরের প্রাণকেন্দ্র রূপে ঢাকা


বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু অধ্যয়ন ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নয়, আর্থসামজিক শোষণ, শ্রেণী ও লিঙ্গবৈষম্য নিরসন এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের সূতিকাগার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আমাদের গৌরবের প্রতীক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১১ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রথম পাতার হেডলাইন ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ পড়ে আমার মতো আরও অনেক প্রাক্তন ছাত্র-শিক্ষক স্তম্ভিত, লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও যৌন নিপীড়ন বাংলাদেশের কোনো নতুন বিষয় নয়, কিন্তু ভাবা হতো, এগুলো মূলত সীমাবদ্ধ স্বল্পশিক্ষিত, রক্ষণশীল গ্রামগঞ্জে, যেখানে বুুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আলো পৌঁছায়নি, যেখানে সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে নারী-পুরুষের ক্ষমতা ও ন্যায্যতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের অপরিহার্যতা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। কিন্তু দেশের উচ্চতম শিক্ষালয়গুলো যেখানে শিক্ষাকে ক্ষমতায়নের মূল সোপান বিবেচনায় নারী শিক্ষা প্রসারের বিশেষ অবকাঠামো সৃষ্টি করা হয়, সেখানে শিক্ষালাভ করতে এসে নারীকে এমন চরম মূল্য কেন দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের হাতে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির অভিযোগ এবং সেই সঙ্গে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করেনি, সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই শুধু দেশ-বিদেশে উচ্চমানের শিক্ষা লাভ করেছেন, তা-ই নয়, বৈশ্বিক উদারমনস্কতার সংস্পর্শে আসার সুযোগ লাভ করেছেন। তাই শিক্ষক—তিনি যেকোনো রকমেরই হোন না কেন—নারীর প্রতি মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধ তাঁর সহজাত আচরণের অংশবিশেষ হওয়া উচিত। পত্রিকায় আরও উল্লেখ করা হয়, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের যৌন নিপীড়ন অতিসাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ কোনো কোনো মাসে ছাত্রীদের প্রতি যৌন নির্যাতনের দুই-তিন ডজন পর্যন্ত অভিযোগ আসে কর্তৃপক্ষের কাছে। এ ছাড়া রয়েছে সহপাঠী বা অন্য ছাত্রদের হাতে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ। এমনকি প্রতারণা ও চরম নির্যাতনের মাধ্যমে ছাত্রীদের পর্নোভিডিও ধারণ করে, তা ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নির্যাতনের এই চরম অবস্থা সভ্য সমাজে অচিন্তনীয়। খবরে এও উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত এপ্রিল মাসেই শুধুই ২৮টি নারী নির্যাতনের অভিযোগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
যৌন হয়রানির শিকার ছাত্রীরা সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে, ভিসি অফিস, প্রক্টরের অফিস ইত্যাদিতে অভিযোগের পরও সুবিচার লাভে বঞ্চিত হওয়ায় উল্লিখিত শিক্ষক দ্বারা প্রত্যাঘাতের আশঙ্কায় মানসিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে—এবং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনে ছেদ টানতে বাধ্য হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, এক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের যৌন নির্যাতন বা যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধর্ষণের একাধিক অভিযোগ উঠলেও অভিযোগকারীরা কোনো সুবিচার পায়নি—উপরন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিম মেয়েদের চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছে। এক দিকে আমরা নারী শিক্ষাকে ক্ষমতায়নের চাবিকাঠি রূপে চিহ্নিত করছি, অন্য দিকে যৌন নিপীড়ন উচ্চশিক্ষার প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ক্রমবর্ধমান যৌন নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি গঠন করার নির্দেশনা দেন। দুই বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ ও বিচারের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করা হলেও আজও ওই কমিটির একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়নি। সাম্প্রতিক বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন ও তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হলেও তা প্রকাশ করে দোষীর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্তরিক ও ন্যায়বিচারপরায়ণ হলে আদালতের নির্দেশনা ও নিজস্ব একাডেমিক নীতি অনুযায়ী প্রতিটি অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দ্রুত সুবিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। অভিযোগ অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধের সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। সেই সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষাঙ্গনের ভেতরে-বাইরে জনমত গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন জেন্ডার ক্ষমতা ও নারীর মানবাধিকার সংরক্ষণের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হবে, তখন তার প্রভাব সমাজের সর্বত্র প্রতিফলিত হবে। এই মনোভাব সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি দেশের আইন মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ ও সুশীল সমাজের রয়েছে বিশেষ দায়িত্ব। আমাদের আরও মনে রাখা প্রয়োজন—আজকের নতুন বাংলাদেশ বির্নিমাণে যাঁরা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁদের বৃহৎ অংশই এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র-শিক্ষক, তাই ‘সৌরভে-গৌরবে’ এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখা তাঁদের সবার নৈতিক দায়িত্ব এবং সেই লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে নারীবান্ধব করার উদ্যোগে এগিয়ে আসতে হবে।
 সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী।

No comments

Powered by Blogger.