টিভি চ্যানেলে কি দেখানো যাবে কি যাবে না

‘দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি রয়েছে’- টিভি চ্যানেল মালিকদের এমন চিত্র দেখাতে বলেছেন সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীরা। চ্যানেল মালিক, প্রতিনিধিদের ডেকে সহিংসতা ও নাশকতা উসকে দেয়ার মতো খবর প্রকাশ না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে সহিংসতা, জঙ্গিবাদ, নাশকতা এই বিষয়গুলো রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখানো যাবে না। বিপরীতে কয়েকটি স্যাটেলাইট চ্যানেলের মালিক ও প্রতিনিধিরা সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীদের দেশ ‘ভাল চলার খবর দেয়ার’ পরামর্শটি মেনে চলার আশ্বাস দেন। গতকাল দুপুরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সিনিয়র মন্ত্রী, বিভিন্ন ইলেট্রনিক মিডিয়ার মালিক ও কর্মকর্তাদের এক মতবিনিময় বৈঠকে এমন নির্দেশনা ও আশ্বাসের ঘটনা ঘটে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এতে মহাসড়ক, মেট্রোপলিটন সিটিসহ বিভিন্ন জায়গায় চলাচলকারী যানবাহনের চিত্র বেশি করে দেখাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি বোমাবাজির চিত্র, বোমায় আহত বা নিহতদের চিত্র, ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়ি পোড়ানো বা গাড়ি বহরে আক্রমণের খবর প্রচার থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। কি দেখানো যাবে ও কি দেখানো যাবে না ওই বিষয়ে মৌখিকভাবে সরকারের গাইড লাইন দেয়া হয়েছে। দুই ঘণ্টার এ বৈঠকে সরকারের পাঁচ জন সিনিয়র মন্ত্রী অংশ নেন। বৈঠকের শুরুতে সরকারের তরফ থেকে দেশের পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ দাবি করে এ বিষয়টি তুলে ধরতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সহযোগিতা চাওয়া হয়। টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধিরা বৈঠক শেষে জানান, সহিংসতা ও রাজনীতির ঘটনাগুলো একসঙ্গে না মিলিয়ে ‘নাশকতার’ সঠিক চিত্র তুলে ধরতে সরকারের আহ্বানে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। মতবিনিময় শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, বিএনপি আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও নাশকতা চালিয়ে সারা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করেছে। সন্ত্রাস এবং নাশকতা মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে না। জাতীয় জীবনে বিবেকের তাড়নায় সন্ত্রাস, সহিংসতা ও নাশকতা প্রতিরোধে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক ও কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, দেশের ব্যবসা, বাণিজ্য, রপ্তানিসহ বর্তমান সব ধরনের অবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে। দেশের বর্তমান অবস্থা প্রকৃত অর্থে স্বাভাবিক। তা সাধারণ মানুষ জানতে পারছে না। দেশের ব্যবসা, বাণিজ্য, রপ্তানি সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। এ বিষয়গুলো মানুষ অবহিত নয়। এ সত্য তুলে ধরার পাশাপাশি হাইওয়েতে প্রতিদিন যে ৫০-৬০ হাজার গাড়ি চলাচল করছে- তা মানুষকে অবহিত করার জন্য মিডিয়া মালিকদের অনুরোধ করেছি, তারা আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন। মানুষ সত্য না জানার কারণ হিসেবে আমির হোসেন আমু বলেন, দুই একটি বাস বা ট্রাক পোড়ানো এমনভাবে মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে বা সমপ্রচার হয়েছে সেজন্য তারা মনে করে সারা দেশে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। এ সত্য বিষয়গুলো দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে মিডিয়া মালিকদের অনুরোধ করেছি। সন্ত্রাস ও নাশকতা কখনও একটা জাতিকে পথ দেখাতে পারে না জানিয়ে তিনি বলেন, সন্ত্রাস জাতিকে, রাজনীতিকে পথ দেখাতে পারে না। আদর্শ স্থাপন করতে পারে না। শিল্পমন্ত্রী বলেন সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ বা নাশকতা এগুলো মানুষকে নিরাপত্তাহীন করতে পারে, নিরাপত্তা দিতে পারে না। আজকে যে কা-  তারা করছে, এতে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে, মানুষের নিরাপত্তা নেই। এ কর্মকা- কোন সরকার বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে করা হচ্ছে না, এটা করা হচ্ছে দেশের বিরুদ্ধে, জাতির বিরুদ্ধে। আমির হোসেন আমু বলেন, মিডিয়াকে জানাতে চাই, তারা (টেলিভিশনের প্রতিনিধি) অনেক কিছু ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তাদের কাছে আমরা অনেক কিছু প্রমাণ সহকারে উপস্থাপন করেছি। তারাও কনভিন্সড এবং তারা বলছেন আন্দোলন ও রাজনীতি এগুলো নয়, এটা সন্ত্রাস ও নাশকতা। সন্ত্রাস ও নাশকতা মানুষকে গাইড করতে পারে না। এগুলো নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের মানুষের কাছে তারা সঠিক তথ্য উপস্থাপন করবেন বলে আমরা একমত হয়েছি। টেলিভিশনগুলোকে এ বিষয়ে কোন  ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে শিল্পমন্ত্রী বলেন, এখানে মতবিনিময় করা হয়েছে। কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি। আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্য হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এখানে সত্যটা তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশে কিছু কিছু নাশকতা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। এখন থেকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় যে জ্যাম সৃষ্টি হচ্ছে, মানুষের জীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে- এসব দেখানো হবে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, চলমান সন্ত্রাস-নাশকতা, অন্তর্ঘাত মোকাবিলায় বৈঠকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। বৈঠকের পর মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অঞ্জন চৌধুরী বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কি দায়িত্ব এবং দেশে যে ঘটনাগুলো ঘটছে এতে আমদের কি ভূমিকা, সে ভূমিকা আমরা কিভাবে পালন করছি। বৈঠকে যা উঠে এসেছে, তা হলো, যা সত্য তা তুলে ধরার জন্য মন্ত্রীরা অনুপ্রাণিত করেছেন। বিএনপির অবরোধ-সহিংসতার বিষয়ে তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এটা আন্দোলন নয়, নাশকতা। অঞ্জন চৌধুরী বলেন, আমরা দেশের জন্য যা ক্ষতিকর, তা অবশ্যই করব না। আবারও বলছি, আন্দোলন নয়, এটা নাশকতা। শুধু মিডিয়াপারসন হিসেবে নয়, দেশবাসী হিসেবেও স্বীকার করেছি। দেশে যেভাবে নাশকতা হচ্ছে, তা যদি আমরা উৎসাহিত করি, তাতে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। নাশকতাকে আমরা যেন সেনসেশনালাইজড না করি, এ ব্যাপরে কিছু মন্তব্যে আমরা একমত হয়েছি। আমাদের দেশের জন্য যা ক্ষতিকর- অবশ্যই তা আমরা করব না। একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু বলেন, আমরা টিভি মালিকরা একমত হয়েছি যে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অপার শক্তি ব্যবহার করে নাশকতা দমনে আমাদের দায়িত্ব পালন করব। নাশকতা দমনে সরকার ও রাষ্ট্রের পাশে থেকে আমরা সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করব। এটি নাশকতা, নাশকতার বিরুদ্ধে দেশ-জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ব্যাপারে আমরা এক সঙ্গে কাজ করব। সরকারের পক্ষ থেকে কোন  সেন্সরশিপ আরোপিত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মোজাম্মেল হোসেন বাবু বলেন, নো, নাথিং। আমাদের ওপর কোন সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়নি। বৈশাখী টিভির প্রধান নির্বাহী মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, নিয়মিত ব্রিফিং, সহিংসতা ও রাজনীতি যেন মিলিয়ে না ফেলি- এ বিষয়ে একমত হয়েছি। সহিংসতা হলো সহিংসতা, আর রাজনীতি মানে রাজনীতি। রাজনীতির জায়গা যদি সহিংসতা দখল করে নেয় তাহলে রাজনীতি বিপদজনক জায়গায় পড়বে। আমরা বলেছি আমরা সুস্থ রাজনৈতিক ধারার পক্ষে এবং আমরা সহিংসতার বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, সন্ত্রাস এবং সহিংসতা একসঙ্গে চলতে পারে না। কাজেই ডিকটেশন বা কোন নির্দেশনা ছিল না। এখানে বিষয়গুলো পর্যালোচনা হয়েছে। বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে তথ্য সচিব মরতুজা আহমেদ বলেন, টেলিভিশনের ভুল সংবাদ মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, গতকালের সংবাদ ২৪ ঘণ্টা পর আপডেট করে তাজা খবর হিসাবে প্রচার করা হচ্ছে। বাসি খবরকে এভাবে তাজা বানালে মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সভাপতিত্বে বৈঠকে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মালিক ও তাদের প্রতিনিধিরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.