সংলাপই একমাত্র পন্থা: ডিসিসিআই

ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) মনে করে, দেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে সংলাপই একমাত্র পন্থা। বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে অবিলম্বে সংলাপের আয়োজন ও আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানায় সংস্থাটি। একই সঙ্গে বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে একটি সিটিজেন কাউন্সিল গঠনেরও মত দেয় ডিসিসিআই। অন্যদিকে গত ১৬ দিনের অবরোধে দেশে মোট অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৬,৪৪৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিসিসিআই। গতকাল ডিসিসিআই মিলনায়তনে দেশের ‘চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক অচলাবস্থা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংগঠনটির সভাপতি হোসেন খালেদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিসিসিআই সহসভাপতি হুমায়ুন রশিদ, সহসভাপতি শোয়েব চৌধুরী, পরিচালক এ কে ডি খায়ের মোহাম্মদ খান, আবদুস সালাম, আতিক-ই-রাব্বানী, ওসমান গনি, এস রুমি সাইফুল্লাহ ও মোক্তার হোসেন চৌধুরী প্রমুখ।
হোসেন খালেদ বলেন, গত কয়েক বছরের যে কোন রাজনৈতিক সঙ্কটে ২ দলকে আলোচনায় বসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এবারও প্রয়োজন হলে আমরা উভয় রাজনৈতিক দলকে সংলাপে বসানোর চেষ্টা করবো। আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব; ততটাই করবো। ডিসিসিআই মনে করে যে কোন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেই তা নিরসনে অবশ্যই কার্যকর আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হবে। যাতে রাজনীতির কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
হোসেন খালেদ বলেন, সঙ্কট নিরসনে সংলাপই একমাত্র পন্থা। পৃথিবীর কোন দেশেই চাপ বা শক্তি প্রয়োগ করে কাঙিক্ষত সমাধান অর্জন সম্ভব হয়নি। তাই আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে অবিলম্বে সংলাপ আয়োজনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে। পেশী শক্তির পরিবর্তে মেধা ও ব্যুৎপত্তির সমন্বয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সব সমস্যার সমাধানে পৌঁছতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসানোর জন্য ডিসিসিআইর পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে কিনা সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সঙ্কট নিরসনে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে যা করা দরকার, আমরা সবই করবো। তাছাড়া সংলাপের জন্য দুই নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছি। যদি আমাদের সুযোগ দেয়া হয় তবে আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারি।
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, শুধুমাত্র বর্তমানের সমস্যা সমাধানের পথ বের করলেই চলবে না। যে কোন রাজনৈতিক সঙ্কট এমনভাবে সমাধান করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে একই ধরনের সঙ্কট তৈরির আর কোন সুযোগ না থাকে। ডিসিসিআই মনে করে, সুষ্ঠু ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার কাঙিক্ষত পরিবেশ উন্নয়ন হলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সহজ হবে।
তিনি বলেন, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা বজায় রাখার লক্ষ্যে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক ইস্যুতে ঐক্যমত সৃষ্টি করে রাজনীতিকে একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোতে নিয়ে যেতে হবে। অবরোধ-হরতাল দেশ ও জনগণের ক্ষতি ছাড়া অন্য কোন কিছু দিতে পারে না। তাছাড়া যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলকেই সব অর্থনৈতিক ক্ষতির বোঝা বহন করতে হয় বলে মত প্রকাশ করেন হোসেন খালেদ।
সিটিজেন কাউন্সিল গঠন: দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সিনিয়র নাগরিক, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ‘সিটিজেন কাউন্সিল’ গঠন করা যেতে পারে বলে মনে করে ডিসিসিআই। এ বিষয়ে হোসেন খালেদ বলেন, আমাদের প্রস্তাবিত ‘সিটিজেন কাউন্সিলের’ সদস্যরা কোনভাবেই রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত হবেন না। তারা সব রাজনৈতিক দলকে সমানভাবে মূল্যায়ন করে গ্রহণযোগ্য সুপারিশ প্রণয়ন করবে যা প্রয়োজনে ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদেও উপস্থাপন করা যেতে পারে।
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, গত ১৬ দিনের অবরোধে দেশে মোট অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৬,৪৪৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রতিদিন দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে ২,৭৭৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। শিল্পে প্রতিদিনের উৎপাদন সক্ষমতায় ২৫ শতাংশ ক্ষতি ধরা হলে দৈনিক ক্ষতি আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। এছাড়া জিডিপিতে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ২.৬৯৭ শতাংশ। তিনি বলেন, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ লাখ ৫০,৯২০ কোটি টাকা। এ হিসেবে বছরের একদিনের জিডিপি ৩,৭০১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। গত ১৬ দিনের হরতাল, অবরোধে জিডিপির ২.৬৯ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। যা কখনোই পুষিয়ে ওঠা যাবে না। যা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়েছেই। এটা আর ফিরে আসবে না। হরতাল অবরোধে দেশের যে ইমেজ গেছে, কাঁচামাল পচে গেছে এটা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক এ অস্থির অবস্থায় স্থানীয় উদ্যোক্তারা যেখানে বিনিয়োগ করে হিমশিম খাচ্ছে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা কষ্টসাধ্য হচ্ছে সেখানে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। এর সুফল প্রতিযোগী পার্শ্ববর্তী দেশগুলো নেবে এটাই স্বাভাবিক। হোসেন খালেদ বলেন, বর্তমানে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ ২,২৭৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। তবে প্রতিদিনের শিল্প উৎপাদনের সক্ষমতায় ২৫ শতাংশ ক্ষতি ধরলে এর পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি হবে মনে করেন তিনি।
হরতাল-অবরোধে খাতভিত্তিক প্রতিদিনের সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরে তিনি বলেন, তৈরী পোশাক রপ্তানিতে ৬৯৫ কোটি টাকা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৩০০ কোটি টাকা, কৃষিখাতে ২৮৮ কোটি ১০ লাখ টাকা, আবাসন খাতে ২৫০ কোটি টাকা, পর্যটন খাতে ২১০ কোটি টাকা, পাইকারি বাজার, শপিং মল, শোরুম, ক্ষুদ্র ও মাঝারি দোকান খাতে ১৫০ কোটি টাকা, পোশাক খাতে ১৪৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা, উৎপাদন খাতে ১০০ কোটি টাকা, স্থলবন্দর ও বঙ্গবন্ধুর সেতুর টোল আদায়ে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ৩৩ কোটি টাকা, সিরামিক খাতে ২০ কোটি টাকা, পোল্টি শিল্পে ১৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা, প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুত ও রপ্তানি খাতে ১৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, বীমা খাতে ১৫ কোটি টাকা, হকার্স খাতে ১৫ কোটি টাকা, স্থলবন্দর আমদানি পণ্য খালাসে ১০ কোটি ৫ লাখ টাকা, হিমায়িত খাদ্য খাতে ৮ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে রাজনীতিবিদদের প্রতি সময়োপযোগী ও যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানান হোসেন খালেদ।
তিনি বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভাল নয়। কিন্তু সরকার পিডিবির পক্ষ থেকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। যেখানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে, সেখানে বাংলাদেশে এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম পুনরায় বৃদ্ধি করা হলে ব্যবসায়ী সমপ্রদায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। এছাড়া দেশে জ্বালানি তেলের দামও কমে আসা উচিত, যা আমাদের কৃষি ও পরিবহন খাতে ইতিবাচক সুফল বয়ে আনবে। তিনি বলেন, চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে যেখানে দেশীয় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে হিমশিম খাচ্ছেন। সেখানে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়টি বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এক্ষেত্রে এফডিআইর বেলায় যেখানে আমরা এমনিতেই পিছিয়ে আছি।

No comments

Powered by Blogger.